খালেদা জিয়ার দাবি ও তথ্য-উপাত্তের বাস্তবতা- নারী নির্যাতন

 নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার দেয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার দূরত্ব অনেক। বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টের সঙ্গে এই তথ্যের কোন মিল নেই।
খালেদা জিয়া সম্প্রতি দাবি করেছেন, বর্তমান সরকারের ১৩ মাসে দেশের ২০ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাঁর তথ্য অনুযায়ী গত ১৩ মাসে দেশে দেড় কোটি নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা। বেসরকারী সংস্থাগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খালেদা জিয়ার এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল নেই। উপরন্তু খালেদা সরকারের তুলনায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ও মহাজোট সরকারের এক বছরে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে অর্ধেকেরও কম। ২০০৬ সালে দেশে ৬ হাজার ৫৪ নারী নির্যাতনের শিকার হয়। ২০০৯ সালে নিযর্াতনের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ৬৭৯ নারী। '০১ সালের চিত্র আরও ভয়াবহ। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিতর্কের ঝড়। রাজনীতিকদের এই আচরণকে 'অপরাধ নীতি' আখ্যায়িত করে ৰোভ প্রকাশ করেছেন নারী নেত্রীরা। তাদের মতে, নিযর্াতনের শিকার নারীদের যাতনা অনুভব না করে রাজনৈতিক ইসু্য তৈরিতেই এ নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়া হয়েছে।
গত ৮ মার্চ আনত্মর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পালন অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এক মনত্মব্য নিয়েই শুরম্ন হয়েছে তোলপাড়, বিতর্কের সূত্রপাত। গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন পেশাজীবী নারীদের সঙ্গে বিএনপি আয়োজিত 'কথা-বিনিময়' অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, 'এ সরকারের আমলে নারী নিযর্াতন বেড়েছে। দেশে গত ১৩ মাসে ২০ শতাংশ নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে।' তাঁর এ বক্তব্যের জবাবে পরদিন ১০ মার্চ ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাযর্ালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, এ বক্তব্য তাঁকে প্রমাণ করতে হবে। কারণ নির্যাতনের শিকার নারীদের নাম ও ঠিকানা প্রকাশ করতে হবে। বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তব্য সত্য হলে গত ১৩ মাসে ১ কোটি ৬০ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
২০০৬-এর তুলনায় ২০০৯ সালে নির্যাতন কমেছে প্রায় আড়াই হাজার- বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য তিনটি বেসরকারী সংগঠন ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত পযর্ালোচনা করলে দেখা যায়, একটি সংগঠনের সঙ্গে অপর সংগঠনের তথ্যের হেরফের হলেও বড় ধরনের পার্থক্য নেই। ১৪টি জাতীয় দৈনিকের কিপিংসের ভিত্তিতে তৈরি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য বিশেস্নষণে দেখা যায়, ১৯৯৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যনত্ম ৫০ হাজার ২৫২ নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, শস্নীলতাহানি, পিতৃত্বের দাবি, এ্যাসিডদগ্ধ, অগি্নদগ্ধ, অপহরণ, নারী ও শিশু পাচার, পতিতালয়ে বিক্রি, যৌতুকের কারণে হত্যা, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, শারীরিক নিযর্াতন, গৃহপরিচারিকা নিযর্াতন, হত্যা, রহস্যজনক মৃতু্য, আত্মহত্যা, ফতোয়া, পুলিশী নিযর্াতন, জোরপূর্বক বিয়ে, প্রেম প্রত্যাখ্যান, উত্ত্যক্ত, উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা ও অন্যান্য এ ২৪ ক্যাটাগরির নিযর্াতনের শিকার হয়েছে এত সংখ্যক নারী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যনত্ম (১৯৯৬-এর তথ্য নেই) ৮ হাজার ৬৯৬ নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে ১ হাজার ৩৬৩ জন, ১৯৯৮ সালে ৫২০ জন, ১৯৯৯ সালে ১ হাজার ৬৯০ জন, ২০০০ সালে ১ হাজার ৯৭৪ জন এবং ২০০১ সালে ১ হাজার ১৪৯ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়ে ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যনত্ম নিযর্াতনের শিকার হয়েছে ৩০ হাজার ৩৭২ নারী। এর মধ্যে ২০০২ সালে ৫ হাজার ৭৯২ জন, ২০০৩ সালে ৫ হাজার ৬১৮ জন, ২০০৪ সালে ৫ হাজার ৯৮৬, ২০০৫ সালে ৬ হাজার ৯২২ এবং ২০০৬ সালে ৬ হাজার ৫৪ নারী নিযর্াতনের শিকার হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৩৫৫ জন এবং ২০০৮ সালে ৩ হাজার ১৫০ নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে। আর মহাজোট সরকারের সময় ২০০৯ সালে নিযর্াতনের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ৬৭৯ নারী।
আইন সালিশ কেন্দ্র ৬টি ক্যাটাগরি পারিবারিক নিযর্াতন, এ্যাসিড নিৰেপ, যৌতুককে কেন্দ্র করে নিযর্াতন, ধর্ষণ, ফতোয়া ও গৃহপরিচারিকা নিযর্াতনের উপাত্ত তুলে ধরে জানিয়েছে, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৫৮৯, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৮৮, ২০০৮ সালে ১ হাজার ৩০৪ এবং ২০০৯ সালে ১ হাজার ১৮৮ নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে।
বেসরকারী সংগঠন অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী, যৌতুক, এ্যাসিড নিৰেপ ও ধর্ষণ এ তিন ঘটনায় ২০০৬ সালে ১ হাজার ১১৫ জন এবং ২০০৯ সালে ৮৭৪ নারী ও শিশু নিযর্াতনের শিকার হয়েছে। এছাড়া ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যনত্ম গত ১০ বছরে যৌতুকের কারণে ২ হাজার ৫৬০ জন, ৭ হাজার ১১৭ জন ধর্ষণ ও ২ হাজার ৪৮ জন এ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০০৯ সালে ১ হাজার ৯২২ নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে। এদিকে ২০০৯ সালে ঢাকা সিএমএম আদালতে নারী নিযর্াতনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৩১১টি।
রাজনৈতিক ইসু্য করবেন না_মত নারী নেত্রীদের এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়শা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, পুরো বিষয়টিকে অপরাধ নীতি বলে মনে হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নারীর কথা ভাবতে শুরম্ন করেছেন এটা ভেবে তাঁর বক্তব্যে আমরা উৎসাহিত বোধ করছি। নারীকমর্ী হিসাবে আমরা কখনও চাই না নারী নিযর্াতনের একটি ঘটনাও ঘটুক। নারী নিযর্াতনের সব ঘটনা রেকর্ড হয় না। তবে নারী নির্যাতন নিয়ে যুক্তিতর্কে যেতে হলে তথ্য হাজির করতে হবে। সেৰেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভিন্ন চিত্র। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর ২০০৬ সালের তুলনায় মহাজোট সরকারের এক বছরে নারী নির্যাতন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০০৬ সালে ৬ হাজার ৫৪ নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে। আর ২০০৯ সালে ৩ হাজার ৬৭৯ জন নারী নিযর্াতনের শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সরকার বা বিরোধী দল কোন পৰেই না। আমাদের লৰ্য নারী নিযর্াতন যেন জিরো টলারেন্সে নেমে আসে। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আমরা পছন্দ করতে পারছি না। বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তাঁর সহকমর্ীরা যখন এ নিয়ে কথা বলছেন, তখন তাঁদের উচিত একবার পেছনের দিকে তাকানো। তাদের সময়ে ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতির পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। সেটাও কিন্তু নারীর স্বার্থবিরোধী পদৰেপ। এ সরকার তাও ৩১টি নারী সংগঠনের মতামত নিয়ে ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতি পুনর্বহাল করেছে। কয়েকটি ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি হসত্মৰেপ করে নির্যাতন বন্ধে তার সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাই নারী নিযর্াতন নিয়ে বিরোধী দল কতটুকু আনত্মরিকতা নিয়ে কথা বলছে সেটাও একটি বিষয়। আমরা চাই স্টান্টবাজির রাজনীতি বন্ধ হোক। বিরোধী দলের নেত্রীকে করজোড়ে বিনীতভাবে অনুরোধ করতে চাই, আপনারা তুলনামূলক পযর্ালোচনায় না গিয়ে সংসদে নারী উন্নয়ন নীতি বিলের ওপর বিরোধিতা না করে তা পাসে সমর্থন দিন এবং নারী নিযর্াতন বন্ধে পদৰেপ নিন।
একইভাবে নারী নিযর্াতন নিয়ে রাজনৈতিক রং না চড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা ইসলাম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এটাকে রাজনৈতিক ইসু্য না করে সমস্যা সমাধানে কিভাবে কাজ করা যায় সেটা নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে। নারী নিযর্াতন বেড়েছে না কমেছে তা ডাটা ও পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য মেলালেই স্পষ্ট হয়। মোটকথা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে না দেখে নারীকে নিয়ে ভাবতে হলে সরকার ও বিরোধী দলকে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। যতই দিন যাচ্ছে ততই নিযর্াতনের ধরন পাল্টাচ্ছে। আগে মানসিক নির্যাতনকে নিযর্াতন বলে গণনা করা হতো না। এখন সেটাকেও নিযর্াতন বলে ধরা হয়। তাই সব ধরনের নির্যাতন বন্ধের জন্য যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। নারী সংগঠনগুলো এখন সরকারের সঙ্গে একটি টিমওয়ার্কের মতো কাজ করছে। আমরা পারিবারিক নির্যাতন বন্ধে আইন প্রণয়নের দাবি করেছিলাম। সরকার সে আইনও করতে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির ডেপুটি ডিরেক্টর এ্যাডভোকেট কোহিনূর বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে নারী নিযর্াতন হচ্ছে এটা সত্যি। তবে বিরোধীদলীয় নেত্রী নিযর্াতনের ধরন স্পষ্ট করে দিলে বিতর্ক এড়ানো যেত। ২০ ভাগ নারী নিযর্াতনের শিকার বলতে তিনি কোন ধরনের নিযর্াতন বুঝিয়েছেন? সেটা কি মানসিক বা পারিবারিক নাকি রাজনৈতিক নিযর্াতন?

No comments

Powered by Blogger.