বাঙালী কোথায়? by ঊর্মি রহমান

বিয়েবাড়ির অথবা বিয়ের উৎসবের আনন্দ অন্য রকম। অনেকের কাছে হয়ত ঝামেলা মনে হতে পারে, আমার সেসব ভাল লাগে। কিন্তু বিলেতে বাঙালীর বিয়েতে খুব বেশি মজা পাই না।
এখানে বিয়ে মানে শুধু খাওয়া-দাওয়া। বর-কনে সেজেগুজে এসে বসে এবং সবশেষে কেক কাটে। কোন শাহ-নজর বা শুভদৃষ্টির অনুষ্ঠান হয় না। একজন বলল, ওসব অনুষ্ঠান নাকি 'হিন্দুয়ানি।' কিন্তু আমার জানামতে বাঙালী মুসলমান যেভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানের এই অংশটি পালন করে, বাঙালী হিন্দুরা সেভাবে করে না। এটা একানত্মই বাঙালী মুসলমান, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানের অনুষ্ঠান। আর সামজিক উৎসবকে ধমর্ীয় রূপ দিতে যাওয়াটা ঠিক নয়, এসবই আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। বিলেতের বিয়েতে আমি মুম্বাইয়ের সিনেমা-সিরিয়ালের প্রভাব দেখেছি। সেই সঙ্গে ইংরেজদের কায়দায় কেক কাটা বাদ যায় না। পরিচিত এক ভদ্রলোক একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "আপনি জীবনে বাঙালী বিয়েতে এর আগে কেক কাটতে দেখেছেন?" দুঃখের বিষয় তাঁর সনত্মানের বিয়েতেও তিনি কেক কাটা এড়াতে পারেননি। এখানে বাঙালীর বিয়েতে আজকাল গায়ে-হলুদ হয় না, হয় 'মেহেদী'। গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানটি মূল বিয়ের দিনের অনুষ্ঠানের চেয়েও আকর্ষণীয়_ উপভোগ্য। অবশ্য শুনেছি বাংলাদেশেও এই চল শুরম্ন হয়েছে। আবার আজকালকার মেয়েরা মুখে হলুদ মাখতেও নাকি রাজি নয়। অথচ কাঁচা হলুদ মাখলে যে মুখের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে সেটা তাদের হয়ত কেউ বোঝায়নি। কারণ আজকালকার মেয়েরা প্রায় সবাই কমবেশি রূপচর্চা করে। এর মধ্যে আমি একটি বিয়ের 'মেহেদী' অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম খানিকটা অনিচ্ছার সাথেই। গিয়ে বুঝেছিলাম সেখানে যাওয়াটা কত বড় ভুল ছিল। সেখানে গিয়ে মনে হলো আমি মুম্বাই ছবির কোন সেটে গিয়ে পড়েছি। হিন্দী, এমনকি পাঞ্জাবী গান বাজছে। ঠিক সিনেমায় যেমন দেখা যায়, তেমনি কনের ভাইবোনরা নাচতে শুরম্ন করল। এক পর্যায়ে হবু বর-কনেও নাচল। তারস্বরে গান বাজছিল। আর এই বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাকে এত বেশি আহত করেছিল যে আমি সহ্য করতে না পেরে সেই কমিউনিটি সেন্টারের উঠোনে গিয়ে বসে ছিলাম। অভ্যাগতদের মধ্যে এক মহিলা, আমাকে বললেন, "আপা, আপনি যে টেলিভিশনে আর খবরের কাগজে বাঙালী সংস্কৃতি নিয়ে এত লেখেন, কিন্তু কি হলো? দেখছেন তো এসব কি হচ্ছে! আপনারা ব্যর্থ!" উলেস্নখ্য আমি কিছুদিন বিলেতের একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেই সন্ধ্যায় সেই মহিলার আৰেপ আমাকে কিছুটা হলেও সানত্ম্বনা দেয়। যদিও তিনি ঠিকই বলেছেন, আমরা, আমাদের প্রজন্ম ব্যর্থ। আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পারিনি। পরের প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারিনি। তবু ভাল লাগল এটা ভেবে যে, তাহলে আমি একা নই। আমার মতো আরও মানুষ আছেন যাঁরা বাঙালী সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে বলে ৰুব্ধ হন, ব্যথিত হন।
এই প্রসঙ্গ তুললাম এজন্য যে, বাঙালী সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে বলে আমার মতো অনেকেই ব্যথিত-চিনত্মিত হয়। প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী লুসি রহমান আমাকে প্রশ্ন করেছিল, "রবীন্দ্রনাথ-নজরম্নল ইসলামের গান কি হারিয়ে যাবে?" বিলেতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আগে এসব গান_নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, রজনীকানত্মের গান শ্রোতারা শুনত, শুনতে চাইত। আজকাল অন্য গান শুনতে চায়, আর লুসির মতো ধ্রম্নপদী শিল্পীদের সেসব গাইতে বাধ্য হতে হয়। বিলেতের ছেলেমেয়েদের যদি বা কিছু যুক্তি থেকে থাকে বাংলা গান না শোনার বা বাংলা বই না পড়ার, কিন্তু বাংলাদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়ের তো সে অজুহাত নেই। তার পরও দেখেছি, তারা বাংলা গান শোনে না, বাংলা বই পড়ে না। ইংরেজীতে কথা বলে। কতটা সঠিকভাবে বলে সেটা বলা মুশকিল। এক পিতামহীকে তাঁর পৌত্র সম্পর্কে ৰুব্ধভাবে মনত্মব্য করতে শুনেছিলাম, "ইংরেজীতে ছাড়া কথা বলে না, কিন্তু সেটাও ঠিকমতো বলতে পারে না । পারবে কি করে, বইপত্র পড়ে?" তিনি বৃদ্ধ বয়সেও নিয়মিত বাংলা-ইংরেজী বই পড়েন, তাঁর আৰেপ হওয়াটা স্বাভাবিক। আজকাল তো অনেকেই ইংরেজী থেকে অনুবাদ করে বাংলা বলে। আজকাল কেউ ফোন 'করে' না, ফোন 'দেয়'। কারণ ইংরেজী ভাষায় কথাটা "গিভ মি এ রিং।" আমাদের এই দুর্ভাবনার মধ্যে আশার আলো জ্বেলে রাখে যেসব সংগঠন, তাদের একটির কথা আপনাদের বলব। গত বছর দেশে গিয়ে আমার প্রিয় শহর চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। বন্ধু দম্পতি মনসুর ভাই-নাজলীর সাথে দু'দিন কাটিয়েছিলাম। আগেই মনসুর ভাই বলে রেখেছিলেন, বিশদ বাংলা নামের একটি সংগঠনে এক সন্ধ্যায় আমাকে কিছু বলতে হবে। আমি 'বলার' মতো কেউ নই। তবু ভাবলাম বিলেতে এতদিন আছি, অনত্মত বিলেতের বাঙালীর সংগ্রাম ও সাফল্যের কথা বলতে পারব। সেখানে গিয়ে সেই সন্ধ্যাটা বড় ভাল কেটেছিল। অনেকে ছিলেন, কিছু পুরনো বন্ধুও ছিলেন। কিন্তু ভাল লেগেছিল বেশ কিছু তরম্নণ-তরম্নণী ছিল। তারা নানা রকম প্রশ্ন করেছিল। সে প্রশ্ন শুধু বিলেতের বাঙালী সম্পর্কে ছিল না, ছিল বাঙালী সংস্কৃতি সম্পর্কে। ছিল প্রজন্মের ব্যবধান সম্পর্কে। ছিল নারীর এগিয়ে যাবার পথের বাধা সম্পর্কে। তরম্নণ প্রজন্মের সেসব প্রতিনিধি আমার মনে আশার আলো জ্বেলে দিয়েছে। আর এই আলো দেখানোর কাজটি করছে বিশদ বাংলা। নিশ্চয় এ রকম আরও সংগঠন আছে, যারা আমাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে আগামী দিনের মানুষদের জানাবে।
এই সংগঠনটির কথা দেশে অনেকে জানলেও বিলেতের বাঙালীরা জানেন কিনা আমার জানা নেই। বিশদ বাংলার সেস্নাগান "বাংলার সবটুকু নিয়ে।" এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে, প্রতিষ্ঠা করেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় দীর্ঘ প্রবাস-জীবন সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসা এক দম্পতি, আলম খোরশেদ এবং তাঁর জীবন-সাথী মাহিয়া আবরার। ব্যক্তিগত জীবনে আলম খোরশেদ প্রকৌশলী ও লেখক, মাহিয়া সঙ্গীতশিল্পী, নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন বিশদ বাংলা গড়ে তুলে তাঁরা একটি বৃহৎ পরিবার গড়ে তুলেছেন। কয়েকটি ঘর নিয়ে বিশদ বাংলার সংসার। একটি ঘরে আছে বাংলার সামগ্রী, শাড়ি-শাল-লুঙ্গি, সিডি-ডিভিডি, বই ইত্যাদি আছে। আরও আছে নানা রকমের কারম্নশিল্প। শীতল পাটি থেকে শুরম্ন করে মুখোশ পর্যনত্ম। উলেস্নখ্য, বিশদ বাংলা কারও কোন অনুদানের ওপর নির্ভরশীল নয় বলে শুনেছি। সংগঠনটির খরচ এসব সামগ্রী বিক্রি করেই চলে। একটি লাইব্রেরীর মতো আছে। একটি রান্নাঘর-খাবার ঘরে বসে চা ও সাথে 'টা' খাওয়া যায়। এই 'টা' কিন্তু নিজেদের তৈরি, কেনা নয়। সেখানে পিঠা যেমন আছে, তেমনি আছে ডালপুরি বা সিঙ্গাড়া বা অন্য কিছু। 'বীজতলা' নামের একটি কোণে আছে নানা রকমের সামগ্রী - ঢেকিছাঁটা চাল, ঘানি ভাঙ্গা তেল, খাঁটি গাওয়া ঘি, সুন্দরবনের চাক-ভাঙ্গা মধু। আরও আছে চানাচুর, আমসত্ত্ব ইত্যাদি। এ সবই আমার মতো অনেককে নস্টালজিয়ায় ভোগায় প্রতিনিয়ত। শৈশবে নানা-বাড়ি, দাদা-বাড়ির গ্রামে যাবার মধুর স্ম"তি মনে করিয়ে দেয়। এসব বিভিন্ন জিনিসের কোনাগুলোর আবার সুন্দর নাম আছে। বইপত্রের বিভাগের নাম 'পূর্ব পশ্চিম।' গানের সিডি ইত্যাদি যেখানে রাখা, তার নাম 'কোমলগান্ধার।' জামা-কাপড় ও দেশজ অলঙ্কারের কোণটির নাম 'হাঁসুলি।' আছে 'পুরাতনী' যেখানে পাওয়া যায় লোকজ হসত্মশিল্প। রান্না-খাবার জায়গাটির নাম 'চাতক।' একটি ঘরে বসে নিয়মিত আড্ডা দেয়া যায়। বেতের চেয়ারে আদিবাসীদের হাতের তৈরি উজ্জ্বল রঙের কাপড়ে ঢাকা। সেখানে স'ানীয় তরম্নণরা আড্ডা দিতে পারেন প্রতিষ্ঠিত কবি-শিল্পীদের সাথে। যে ঘরটিতে বসে আমরা কথা বলেছিলাম, সেটির নাম 'পরম্পরা।' সেখানে শুধু আলোচনা নয়, গানের আসরও বসে শুনলাম। চলি"চত্র প্রদর্শনী হয়। চিত্রশিল্পের প্রদর্শনী হয়। একটি সাময়িকীতে এক সাৰাতকারে আলম খোরশেদ বলেছিলেন, "আমাদের লৰ্য সম্পূর্ণ বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা থেকে শুরম্ন করে পোশাক, খ্যাদ্যাভাস ও গৃহসজ্জার রম্নচি তথা সামগ্রিক সংস্কৃতির প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা। শ্রেণী, ধর্ম ও জাতিসত্তা নির্বিশেষে আমরা বাংলা ভূখ- ও সংস্কৃতির অনত্মর্গত সকল জনগোষ্ঠীর সৃজনশীলতা ও জীবনচর্চাকে ধারণ করতে চাই আমাদের এই সমন্বয়বাদী প্রতিষ্ঠান বিশদ বাংলার বিসত্মৃত পাটাতনে।" এ রকম যদি আরও অনেকে এগিয়ে আসন, গড়ে তোলেন কোন সংগঠন, গোষ্ঠী, তাহলে হয়ত আমরা বাংলা সংস্কৃতিকে হারিয়ে যাওয়া থেকে রৰা করতে পারব।

No comments

Powered by Blogger.