একুশ শতক- ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বাংলা একাডেমীর মস্করা by মোসত্মাফা জব্বার

বাংলা একাডেমীর মতো একটি প্রতিষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ের বিষয়গুলো গুরুত্ব দেবে এবং সেসব বিষয় উপস্থাপন করার সময় সব প্রকারের সতর্কতা অবলম্বন করবে_এটিই বাংলাদেশের সব মানুষের কামনা।
এটি বাঙালীর আবেগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে এর অবদান অপরিসীম। তবে প্রতিষ্ঠানটি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব এখন কেমন করে পালন করছে সেটি নিয়ে জনগণের বা একাডেমীর সদস্যদের এখন আর প্রশ্ন্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এর কোন নির্বাচিত পরিচালনা পরিষদ নেই। কবে যে এই পরিষদের নির্বাচন হবে সেটিও আমরা জানি না। একাডেমীর পরিচালনার জন্য সরকারের নিযুক্ত মহাপরিচালকরা কখনও এ বিষয়ে কথা বলেন না। বছরে একটি সাধারণ সভায় যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ থাকে তাতে পুরো বছরের কর্মকা-ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
যাই হোক এর জন্য একাডেমী তো বসে নেই। নির্বাচন না হলে আমলারা গ্যাপ পূরণ করেন। একাডেমীতে তাই হচ্ছে। তাই তারা আর কিছু করম্নন বা না করম্নন প্রতি বছর ফেব্রম্নয়ারি মাসে বইমেলা চলাকালে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিয়মিত আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকেন। একাডেমী এবার মেলা শুরম্নর প্রথম দিনেই আয়োজন করে ডিজিটাল বাংলাদেশবিষয়ক আলোচনা সভা। আলোচনার দিনের দু'দিন আগেই একাডেমীর পৰ থেকে কেউ একজন আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে অন্যতম আলোচক হবার জন্য। তখন তারা কেউ জানাননি যে, এই বিষয়ে ক'টি মূল প্রবন্ধ পঠিত হবে বা কারা কারা এই বিষয়ে প্রবন্ধ লিখবেন। শনিবার অবধি কোন চিঠি না পেলেও রোববার চিঠির সঙ্গে দুটি প্রবন্ধ পাঠানো হয়। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির লোকেরা রোববার রাতে লেখা দুটির সঙ্গে চিঠিটি আমার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমি আগেই জানিয়ে ছিলাম যে, অন্য একটি কাজ থাকায় আমি একটু দেরিতে পেঁৗছাব। কাজের চাপ এত বেশি ছিল যে প্রবন্ধ দুটিতে চোখ বুলাতে পারিনি। গুলশানে একটি কাজ সেরে ঢাকা শহরের প্রচ- জ্যাম ঠেলে আমি যখন বাংলা একাডেমীর মঞ্চে পেঁৗছাই তখন একটি প্রবন্ধ পঠিত হয়ে গেছে। পঠিত প্রবন্ধটির লেখক রম্নশো তাহের। তিনি মঞ্চে বসে ছিলেন। অন্য প্রবন্ধটির লেখক আসিফের ব্যক্তিগত কোন দুর্ঘটনার জন্য তিনি আসতে পারেননি। তার লেখাটি তখন একটি মেয়ে পাঠ করছে। সেই সুবাদে প্রবন্ধটি শোনা হলো। এরপর একাডেমীর একজন আলোচক ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করলেন। অপরেশ নামক একাডেমীর কর্মকর্তা সেই আলোচক এত সাদামাটা আলোচনা করলেন যে, আমি সেই সময়ে আলোচনা না শুনে রম্নশোর লেখাটি পড়া যুক্তিযুক্ত মনে করলাম। আমি ঠিক জানি না অপরেশ কেন আলোচক হলেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক সেটওি আমি জানি না। আমি এর কেন্দ্রে অবস্থান করে অপরেশকে কোথাও ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কোন কাজ করতে দেখিনি বা শুনিনি। হতে পারে একাডেমীর নিজস্ব কাউকে আলোচক হিসেবে কিছু অর্থ প্রদানের জন্য এই ব্যবস্থা।
রম্নশোর প্রবন্ধের শুরম্ন হয়েছে ডিজিটাল জগত নিয়ে। তিনি বাইনারি অঙ্ক বুঝিয়ে ডিজিটাল জগতের কথা বললেন। এরপর তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের সংজ্ঞার কথা বললেন। তার মতে, কম্পিউটার ইন্টারনেট ও ইনফরমেশন টেকনোলজি দিয়ে সব কর্মকা- হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। তিনি সব ই- কেই (ই-গভর্নমেন্ট, ই-হেলথ ইত্যাদি) ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তি বললেন। তারপর তিনি ডিজিটাল ঢাকা থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথাও বললেন। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম এবং তার সমাধান হয়ে উঠল ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এরপর কমপ্যাক্ট ভিলেজশিপ, ডিজিটাল সিটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রসত্মাবনা পেশ করা হলো নিবন্ধে। রম্নশো ফাইবার যোগাযোগ এবং রেডিওকে টেনে আনলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ আলোচনায়। প্রবন্ধটির শেষে দেখা গেল যে, লেখক রেডিওএ্যাস্টনমি ও ডিজিটাল কমিউনিকেশন বিষয়ের গবেষক। আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে অনেক আলোচনা বিগত এক বছরে পড়েছি বা শুনেছি। যিনি যেভাবে পেরেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন। এসব প্রবন্ধ পাঠ করতে গিয়ে আমাদের অবস্থা হয়েছে, অন্ধের হাতি দেখার মতো। এতে আমরা কখনও এই হাতির কান দেখেছি, কখনও চোখ দেখেছি বা কখনও পা দেখেছি। আবার কখনও একেবারে উল্টো কিছু দেখেছি। তবে রম্নশো তাহের যেভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন তেমনটা আর কখনও দেখিনি। ডিজিটাল বাংলাদেশকে এমনভাবে উপস্থাপিত করার পর সেটি নিয়ে কি আলোচনা করব সেটিই ভাবতে পারছিলাম না।
অন্যদিকে আসিফ সাহেব ডিজিটাল বাংলাদেশ বিকেন্দ্রিকরণের পথে নামক নিবন্ধে ডিজিটাল প্রযুক্তি-জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, শিল্প পুঁজিতন্ত্র ও ডিজিটাল পুঁজিতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করলেন। ই-গভর্নমেন্ট ইত্যাদি নিয়েও লিখলেন।
দুটি প্রবন্ধ পাঠ করে-শুনে আমার মনে হলো-ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আমি এসব কি শুনছি। রম্নশোকে দেখে মনে হলো, তিনি বয়সে তরম্নণ। আমার পাশে বসা অপরেশ জানালেন, আসিফও তরম্নণ। অপরেশ সম্ভবত জানা সত্ত্বেও আমাকে এটি বললেন না যে, তারা সরকারী দলের কোন পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী। আমি সরকার সমর্থক প্রায় সব প্রধান বুদ্ধিজীবীকেই চিনি, কিন্তু কখনও এদের নাম শুনিনি। ওরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কোন কাজের সঙ্গে জড়িত বলেও স্মরণ করতে পারলাম না। অপরেশের কাছে জানতে চাইলাম-বাংলা একাডেমী ডিজিটাল বাংলাদেশকে এত কম গুরম্নত্ব দিল কেন? অপরেশ যা বললেন তার অর্থ হলো, সেটি কেবল ডিজি সাহেব জানেন। তিন বছর ধরে আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে লিখি। পুরো একটি বছর ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যেমন নিজে কথা বলেছি তেমনি করে অন্যকেও অনেক কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু রম্নশো ও তাহেরকে তো কোথাও কোন কাজে দেখিনি।
যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের মাঝে আছেন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের মুনির হাসান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন সেলের অনির চৌধুরী, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের মাহফুজুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর একানত্ম সচিব এন আই খান প্রমুখ। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছে তার মাঝে রয়েছে বিজ্ঞান এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগযোগ মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি বা কম্পিউটার কাউন্সিল রয়েছে। বাংলা একাডেমী এদের কাউকে নিবন্ধ লেখার জন্য কোন অনুরোধ পত্র পাঠিয়েছে বলেও জানা গেল না। আমি পরে এদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এ বিষয়ে একাডেমীর সঙ্গে কোন যোগাযোগের কথা স্মরণ করতে পারলেন না। আমি ধারণা করি একাডেমী তেমন কোন চেষ্টাও করেনি।
এমন এক অবস্থায় আমি যখন সভাপতির আগের সর্বশেষ আলোচক হিসেবে আলোচনা করতে যাই তখন খুব সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্নগুলো তুলতে হয়েছে যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিহাস ও পরিপ্রেৰিত কি, আওয়ামী লীগ কি হঠাৎ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছে, আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে কেমন করে এল এই কর্মসূচী, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে কি বোঝায়, সরকার এই কর্মসূচী বাসত্মবায়নের জন্য কি কি কর্মসূচী হাতে নিয়েছে, আইসিটি পলিসি ২০০৯-এর সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশের কি সম্পর্ক রয়েছে ইত্যাদি। আমি স্মরণ করতে বাধ্য হলাম যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ নামক একটি কর্মসূচী আছে_ ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে আমার লেখা একটি বই আছে, যার তিনটি সংস্করণ নিঃশেষিত হয়েছে এবং সরকারের বর্ষপূর্তিতে এই বিষয়ে আমার একটি লেখাও ছাপা হয়েছে। বিস্মত হলাম যে, লেখকদ্বয় অন্য কারও লেখা থেকেও একটি বাক্য বা চরণ উদ্ধৃত করলেন না। কোন লেখা থেকে কোন ধারণার কথাও বললেন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তারও উলেস্নখ করলেন না। ২০০৯-১০ সালের বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ডিজিটাল বাংলাদেশের যে ধারণা দিয়েছিলেন তারও কোন উলেস্নখ করলেন না।
প্রবন্ধ দুটির লেখকরা যদি প্রবন্ধ লেখার একটি অতি সাধারণ নিয়ম বা সংজ্ঞার কথাও ভাবেন তবে যে বিষয়ে তারা প্রবন্ধ লিখেছেন সেই বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত ওপরের বিষয়গুলোকে কোনভাবেই অবজ্ঞা করতে পারেন না বা এড়িয়ে যেতে পারেন না। একথা বলার অপেৰা রাখে না যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়টি দেশের সর্বসত্মরের মানুষের কাছেই ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। বাংলা একাডেমীতে প্রধানত সৃজনশীল তরম্নণ মানুষেরা গিয়ে থাকেন। দর্শকদের শতকরা প্রায় নব্বইভাগ মানুষ নতুন প্রজন্মের। বলা হয়ে থাকে যে, এই নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশ কামনার বিষয়। সেই নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছে শামসুজ্জামান খানের মতো মানুষ শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের এমন অদ্ভুত চিত্র তুলে ধরবে তা কোনভাবেই ভাবা যায় না।
প্রবন্ধ দুটি পাঠ করে আমার নিজের কাছেই মনে হয়েছে যে, দুটি প্রবন্ধের কোনটিতে কেন অনত্মত এই বিষয়টি আলোচিত হয়নি যে বিগত এক বছরে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য কি কর্মসূচী হাতে নিয়েছে এবং কোনটা ভাল করেছে বা কোনটা খারাপ করেছে। প্রবন্ধ দুটিতে যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর অসঙ্গতি, সমন্বয়হীনতা বা বিভ্রানত্মি নিয়ে আলোচনা হতো তবুও আমি খুশি হতাম।
আমি তো মনে করি একাডেমী ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো বিষয়ে এমন একটি কাজ করে বরং সরকারের মূল ভাবনাকে হেয় করেছে।
প্রথমে আমি বুঝতেই পারিনি যে, একই দিনে যখন অনেক দেরিতে প্রবন্ধ পাঠের ব্যবস্থা করতে হলো তখন এই বিষয়ে দুটি প্রবন্ধ কেন উপস্থাপিত হলো। একটি প্রবন্ধ পাঠের সময়ও তো সেদিন ছিল না। সেদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয় বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। ফলে ছটার আগে অনুষ্ঠান শুরম্ন করা সম্ভব হয়নি।
পরে দেখলাম, দুজন প্রবন্ধ লেখকের জন্য একাডেমীর পৰ থেকে জনপ্রতি আড়াই হাজার করে টাকার সম্মানী প্রদান করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার ভাবতে এটি খারাপ লাগছে যে, একাডেমী কতর্ৃপৰ দুইজন অযোগ্য মানুষকে পাঁচ হাজার টাকা পাইয়ে দেবার জন্যই কি ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো একটি বিষয়কে ছিন্ন ভিন্ন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশের নতুন প্রজন্মের মানুষদের যে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখালেন তাকে নিয়ে এমন তামাশা করাটা কি আদৌ জরম্নরী ছিল?
আমার এটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, ডিজিটাল বাংলাদেশবিষয়ক আলোচনাটি ছিল কার্যত সরকারের এই কর্মসূচি নিয়ে যে সাফল্য তার বিপরীত চিত্রটি তুলে ধরা। অথবা পুরো ব্যাপারটি নিয়ে একটি মস্করা করা। এমনিতেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বিএনপি ও তার দোসররা সুযোগ পেলেই সরকারের ও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে। বাংলা একাডেমী তাদের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দেবার জন্য এমন আর একটি কাজ না করলেও পারত।
ঢাকা, ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রবক্তা ই-মেইল ঃ সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স, ওয়েবপেজ: িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ

No comments

Powered by Blogger.