শ্রমিক অধিকার-প্রতি জেলায় শ্রম আদালত by নাহিদ হাসান নলেজ

শ্রমিকের মৃত্যু-পঙ্গুত্ব-নির্যাতন আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। আগুনে মৃত্যু, ভবন ধসে মৃত্যু, বাস-ট্রাক উল্টে মৃত্যু, বয়লার বিস্টেম্ফারণে মৃত্যু, ভবন নির্মাণকালে মৃত্যু, গৃহকর্ত্রী আর হোটেল মালিকের নির্যাতনে মৃত্যু প্রতিকারহীনভাবে চলছে, মৃত্যুর যেন শেষ নেই।
উৎপাদন বৃদ্ধি আর মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার দৌড়ে সবাই এই মৃত্যুর মিছিল মেনে নিয়েছে। ফ্যাসিবাদের প্রবর্তক মুসোলিনি পর্যন্ত বলেছিলেন, 'বুদ্ধিমান ক্যাপিটালিস্টরা তাদের শ্রমিকদের শুধু বেতনের দিকেই মনোযোগ দিয়ে ক্ষান্তি দেয় না, বুদ্ধিমান ক্যাপিটালিস্টরা তাদের শ্রমিকদের জন্য বাসভবন, বিদ্যালয়, হাসপাতাল ও ক্রীড়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার দিকেও দৃষ্টি রাখে।' অর্থাৎ বুদ্ধিমান গোয়ালে বেশি দুধ পাওয়ার জন্য গাভীকে শুধু ভালো খাবার-দাবারই দেয় না, গোয়ালঘরও পরিষ্কার রাখে, মাঝে মধ্যে গরুর স্বাস্থ্যও পরিচর্যা করে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আইয়ুব খাঁর আমলের নূ্যনতম মজুরিতে অর্থাৎ ১২৫ টাকার পণ্য পেতে এখন গড়ে ১৬ হাজার টাকা লাগে। সে দাবিও কথিত বামপন্থিরা উত্থাপনও করেনি। ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির দাবি তো দূর অস্ত।
উৎপাদক শ্রেণীর অধিকারের দিকটি হচ্ছে নির্ধারক পয়েন্ট। ফ্যাসিবাদী আচরণের এক ধরনের প্রকাশ হচ্ছে_ সমর্থন বা ভোট পাওয়ার জন্য, সুবিধা পাওয়ার জন্য যে কোনো কথা দিতে রাজি থাকা। আমাদের শাসক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার আর পরে তা বাস্তবায়নের তুলনাটা করলে আমরা টের পাব। অন্যদিকে বামপন্থিদের বেলায় সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক আওয়াজের বদলে চলে আসে জাতীয় আওয়াজ। আসে মূলত মধ্যবিত্ত আর শ্রেণীচ্যুতদের গলা থেকে, অতীত ফিরে ফিরে উঁকি দেয়। চটকদারি বামপন্থি স্লোগান কিন্তু শ্রেণীপ্রশ্ন অস্পষ্ট। অন্যদিকে ব্যবসায়ী মহলের হরতাল বন্ধের দাবি ইত্যাদি।
স্বাধীন বাংলাদেশে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে গেছে বহুগুণ। কিন্তু পাকিস্তান আমলে শ্রমিকদের ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন করার জন্য যুগ্ম শ্রম পরিচালকের কার্যালয় ও বিচার পাওয়ার জন্য শ্রম আদালতের সংখ্যা যে ৭টি ছিল, তাই আছে, একটিও বাড়েনি। এগুলো ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি করে এবং খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীতে একটি করে। অথচ ইপিজেড, শিল্পাঞ্চল, বিসিকসহ অলিগলিতে অজস্র কলকারখানা গড়ে উঠেছে; রাষ্ট্রীয় খাতকে অতিক্রম করেছে বেসরকারি খাত; গ্রামগঞ্জে গড়ে উঠেছে রিকশা-লেদ-গার্মেন্ট-মোবাইল-কম্পিউটার ইত্যাদি খুচরা কারখানা; দুর্গম চর ও চা বাগানে হোটেল-রেস্তোরাঁ। কিন্তু দাবি আদায় তো দূরে থাক, সংগঠিত হওয়ার আর বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ। চিলমারীর চর বা হবিগঞ্জের চা বাগান থেকে কোন শ্রমিক যাবে মহানগরীগুলোতে বিচারের আশায়? মালিকের দয়া ছাড়া পথ বন্ধ।
আমাদের মালিক পক্ষ ততটুকুই শ্রমিক অধিকার রক্ষা করতে প্রস্তুত বিদেশি রাষ্ট্র জেএসপি সুবিধা বন্ধের হুমকিতে যতটুকু চায়। ফলে রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকরাই অতটুকু সুবিধাপ্রাপ্ত হবে আর বাকি বিপুল সংখ্যক শ্রমিক থেকে যাবে এর বাইরে। তাহলে ফ্যাসিবাদই কি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ? যেখানেই নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মজুরি তফাত; যেখানে সংবিধানে বাঙালি জাতি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের আধিপত্য; যেই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকতার পূর্বশর্ত শ্রমজীবীদের সংগঠিত হওয়ার ও বিচার পাওয়ার শর্তের ওপর, তার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা; যেখানে বামপন্থিদের নীতিনির্ধারণে শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব নেই; সেখানে ফ্যাসিবাদই ভবিষ্যৎ।
আজ যদি আমরা যথার্থ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চাই, ফ্যাসিবাদের হাত থেকে বাঁচতে চাই, তাহলে শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত হওয়ার আর বিচার পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রধান শহরগুলোতে যুগ্ম শ্রম পরিচালকের কার্যালয় ও প্রতি জেলা শহরে শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে প্রত্যেক গণতন্ত্রকামী মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, বাধ্য করতে হবে রাষ্ট্রকে। কারণ, শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধিই গণতন্ত্রকে মুক্তি দেবে।

নাহিদ হাসান নলেজ : সভাপতি, নদীভাঙন প্রতিরোধ ও চিলমারী নদীবন্দর পুনর্বাস্তবায়ন কমিটি
nahiduttar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.