বাংলার লোকজীবন ও লোকঐতিহ্যেও এক অনন্য ধারা by ইকবাল আজিজ

বাংলার অতি সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি বাঙালীকে সরল সহৃদয় ও মানবতাবাদী করেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্ম নদীমাতৃক বাংলার নিজস্ব লোকাচারের সাথে সংমিশ্রিত হয়ে এক মানবিক লোকধর্মের রূপ লাভ করেছে।
বট শিরিষ কৃষ্ণচূড়া হিজল তমাল নারকেল সুপারি প্রভৃতি অসংখ্য সবুজ বৃ বাংলার চিরসবুজ প্রকৃতিকে করে তুলেছে অপূর্ব রূপময়। ধমর্ীয় গোঁড়ামি কখনই বাংলার লোকজীবনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে অবরম্নদ্ধ করে তোলেনি। কট্টরপন্থার বদলে উদারহৃদয় সুফিবাদ ও চৈতন্য দেবের বৈষ্ণব ধর্ম বাংলার সাধারণ মুসলমান ও হিন্দুদের প্রাণের ধর্মে রূপানত্মরিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে দলমত ও ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালীর কল্যাণময় জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন, তা এই সাধারণ বাঙালীর লোকধর্ম ও মানবতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বহু প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় যেসব সুফিবাদী পীরের আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের ভক্ত শুধু মুসলমান নয়; বরং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও তাদের অনেক ভক্ত দেখতে পাওয়া যায়। বাংলার আউল, বাউল ও ফকিররা বাসত্মবিকই সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মসাধনার একটি আলাদা ধারা তৈরি করেছেন। বিভিন্ন জেলায় আচরণ ও প্রয়োগের েেত্র পার্থক্য থাকলেও এর মূল সুর মানবতাবাদী। এক ধরনের দেহতত্ব ও মরমীবাদকে ঘিরে বাঙালীর লোকধর্মের আনন্দময় অন্বেষণ।
বাংলার বিসত্মীর্ণ এলাকাজুড়ে এই লোকঐতিহ্যের অনন্য ধারা বাঙালীর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়ায় শৈশব থেকে দেখেছি বাউল গানের আসর। জাতিগত সমন্বয় ও সাম্যই বাউল গানের অনত্মর্নিহিত সুর। আমাদের সব প্রধান নেতাই এই সাম্য ও সমন্বয়ের বাণী প্রচার করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানী তাঁদের অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রেম ও গণউন্নয়নমূলক রাজনীতির মধ্য দিয়ে বাংলার লোকচেতনাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন এবং ধীরে ধীরে বাঙালীর লোকনায়কে পরিণত হয়েছেন। জনসভায় তাঁদের অভিব্যক্তি ও উচ্চারণ ছিল বাঙালীর লোকজ কথ্যভাষাকে ভিত্তি করে। এইভাবে তাঁরা সাধারণ মানুষের মুখপাত্র বা কথক এবং তাদের প্রাণের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। বাসত্মবিকই বাংলাদেশের গত ৬৩ বছরের (১৯৪৭-২০১০) রাজনীতিও বাঙালীর এই লোকজীবনকে ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছে।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অসত্মিত্ব একটি রাজনৈতিক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ; কিনত্মু বাংলার ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মানচিত্র অনেক বিসত্মীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। লোকসাহিত্যবিদ দীনেশচন্দ্র সেন যে 'বৃহৎ বঙ্গর' কথা বলেছেন, তার ভাবজগৎ এক সুবৃহৎ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও অসমের এক সুবিশাল এলাকা অনত্মভর্ুক্ত ছিল। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সিলেট চিরকালই বঙ্গভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ত অবস্থানগত কারণে তা কিছু বছর আসামের অনত্মভর্ুক্ত ছিল। কিনত্মু কালের বিবর্তনে তা ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিসত্মানে এবং পরবতর্ীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়। বাংলার ভাব আন্দোলনে সিলেটের অবদান অপরিসীম। সিলেটে অনেক খ্যাতিমান মানুষের জন্ম হয়েছে। বৈষ্ণবদের আদিগুরম্ন শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমি সিলেট। বিপিন চন্দ্র পাল, নীহাররঞ্জন রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, অমিতাভ চৌধুরী প্রমুখ জ্ঞানসাধকদের জন্মস্থান এই বৃহত্তর সিলেট। হজরত শাহজালাল (রাঃ) ও তাঁর সহযোগী ৩৬০জন আউলিয়া সিলেটকে দিয়েছেন একটি রূপময় আধ্যাত্মিক মহিমা। বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকসঙ্গীতের এক আশ্চর্য সমৃদ্ধ ভা-ার এই সিলেট। সম্প্রতি কবি ও গবেষক মোহাম্মদ সাদিকের একটি ব্যতিক্রমধমর্ী গবেষণাগ্রন্থ 'সিলেট নাগরী: ফকিরি ধারার ফসল' হঠাৎ করেই হাতে পেয়েছিলাম। বইটি পড়ে আমাদের লোকজ ভাবজগতের এক অদেখা প্রানত্মর আমার চেতনায় এক সোনাঝরা প্রানত্মররূপে হাজির হয়েছে। বইটি বঙ্গভূমির একটি সাধকগোষ্ঠীর নিজস্ব লিপিমালা বিষয়ে, যার নাম 'সিলেট নাগরী'। সিলেটের একটি মুসলিম সাধকগোষ্ঠী তাঁদের জ্ঞানচর্চার জন্য এই আলাদা লিপিমালার উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন। কয়েক শতাব্দী চালু থাকার পর ব্রিটিশ আমলে এই লিপিমালাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। মোহাম্মদ সাদিক একটি বিশাল বইজুড়ে 'সিলেট নগরী' বিষয়ে তার গবেষণা উপস্থাপন করেছেন। এই অবলুপ্ত লিপিমালা বিষয়ে আমি প্রাথমিকভাবে জেনেছিলাম ষাট দশকের শেষদিকে মুহম্মদ আব্দুল হাই সম্পাদিত 'সাহিত্য পত্রিকায়'। কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরীতে এই অতিশয় মানসম্পন্ন গবেষণা পত্রিকার বেশ কিছু কপি সংরৰিত ছিল।
এতকাল পরে মোহাম্মদ সাদিকের বদৌলতে 'সিলেট নগরী' বিষয়ে বিসত্মারিতভাবে জানতে গিয়ে সিলেটের উঁচুনিচু টিলা, রূপময় সবুজ বৃ ও সুরমা নদীর কল কল ধ্বনি শুনতে পেয়েছি এক আশ্চর্য উদাসীন মারেফতি বৈরাগ্যে। তাঁর বইয়ের মধ্য দিয়ে বার বার আমাদের লোকঐতিহ্যের সমৃদ্ধি আবিষ্কার করেছি এবং এ বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বক্তব্যের সততাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেছি। সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৪৭ সালের ৩০ নবেম্বর সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভায় 'পূর্ব পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা' শিরোনামে এক লিখিত বক্তৃতায় বলেছেন, "ভাষার বাজারে বহু বছর ধরে এ অধম বড় বড় মহাজনদের ফাই-ফরমাস খেটে দিয়ে তাঁদের আড়তের সন্ধান নিয়েছে এবং সে হলফ খেয়ে বলতে প্রস্তুত, লোকসাহিত্যের ফরাসী, জর্মন, ইতালি, ইংরেজী আড়তের কোনোটিতেই পূর্ববঙ্গ লোকসাহিত্যের মতো সরেস মাল নেই। আমাদের ভাটিয়ালি মধুর কাছে ভলগার গান চিটেগুড়। হাছন রাজা, লালন ফকীর, সৈয়দ শাহনূরের মজলিসে এসে দাঁড়াতে পারেন এমন একজন গুণীও ইউরোপীয় লোকসাহিত্য দেখাতে পারবে না"। বাসত্মবিকই আমাদের জীবনবোধের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে আমাদের লোকঐতিহ্য। আর সিলেট বরাবরই আমাদের অতিশয় সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতির আলোকিত বিচরণ ত্রে। বৃহত্তর সিলেট বলতে আমরা বুঝি সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং ভারতের কাছাড় ও করিমগঞ্জ। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে হজরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সহযোগী দরবেশরা সিলেটে আগমন করেন। এই সুফিবাদী মহাপুরম্নষের আগমন সিলেটের জনজীবনে ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির েেত্র এক ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। নিরাকার আলস্নাহর উপাসনা ও ইসলামী সামাজিক সাম্য ও মানবতা সেখানকার লোকজীবনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ভাষাতত্ত্ববিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও আরও কিছু প-িতের মতে, এ সময় সিলেট অঞ্চলে এই লিপির উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। 'সিলেট নাগরী' বিষয়ে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় যা বর্ণিত আছে, তা নিম্নরূপ :
"সিলেট নাগরী বাংলা লিপির বিকল্প এক প্রকার লিপি। এক সময় প্রধানত সিলেট অঞ্চলে এটি প্রচলিত ছিল। তবে সিলেটের বাইরে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা এবং আসামের কাছাড় ও করিমগঞ্জে এর ব্যবহার ছিল। আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির সংমিশ্রণে চতুর্দশ শতকের প্রথম দশকে এ লিপির উদ্ভব ঘটে। আরবি ও ফারসি ভাষার সঙ্গে সিলেটের স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে যে মুসলমানি ভাষার প্রচলন হয়, তার বাহন হিসেবে সিলেট নাগরী ব্যবহৃত হতো। সিলেটের তৎকালীন মুসলমান লেখকগণ বাংলার পরিবর্তে এই লিপিতেই ধমর্ীয় বিষয়সমূহ চর্চায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। হজরত শাহজালাল (র.) এর সমসাময়িক মুসলমান ধর্মপ্রচারকগণ এই লিপিতে ধর্মমত লিপিবদ্ধ করতেন বলে জানা যায়।"
কয়েক শতাব্দী ধরে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে প্রধানত পীর-দরবেশ ও সাধকরা এই লিপির পরিচর্যা করেছেন। শিষ্যদের কাছে এই লিপিতে শিাদান সম্পন্ন হয়েছে। মূলত মুসলিম ধমর্ীয় জ্ঞানসাধকদের মধ্যে 'সিলেট নাগরী' লিপির প্রচার, প্রশিণ ও কার্যকারিতা সীমাবদ্ধ থেকেছে। এ যেন আমাদের লোকঐতিহ্যের এক মরমী অধ্যায়। হজরত শাহজালালের (র.) আগমনের পর থেকে সিলেটের মাটিতে যে নিবিড় নিভৃত ফকিরী প্রবাহ চালু থেকেছে, 'সিলেট নাগরী' তার ভাষাগত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। সাধকরা এ মহাবিশ্ব ও মহাজীবনের রহস্যের কথা ভাবতেন এবং ইহলোকে সমাজবদ্ধ মানুষের জন্য সৎ ও ন্যায়বিচারভিত্তিক শানত্মিপূর্ণ জীবন প্রত্যাশা করতেন। ফকিররা এই গভীর জ্ঞান বা গুপ্তজ্ঞান সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করতেন না। কারণ তারা উপলব্ধি করেছিলেন, মারেফাতের 'গুপ্তজ্ঞান' কেবলমাত্র তাঁদের মতো সাধকদের বোঝার মতা আছে; সাধারণ মানুষের প েতা ধারণ করা সম্ভব নয়। ফকিররা তাঁদের গুপ্তজ্ঞান ধারণের জন্য এই 'সিলেট নাগরী' লিপি ব্যবহার করেছেন এবং প্রায় সাতশ বছর ধরে তা চালু ছিল। মোহাম্মদ সাদিক তাঁর এই বইয়ে সিলেট নাগরী এবং সিলেটের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক প্রোপট বিষয়ে বিসত্মারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর এ মূল্যবান গবেষণা বাঙালী জাতিকে তাদের গৌরবময় লোকঐতিহ্য বিষয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণার উৎসাহ যোগাবে।
বাংলাদেশে সুফি সাধকরা সবসময় প্রেমময় মানবতার বাণী প্রচার করেছেন। বিভ্রানত্মিকর ধমর্ীয় কট্টরপন্থীদের বিরম্নদ্ধে হজরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সহযোগী দরবেশরা সবসময় মানবপ্রেমের আলো জ্বেলেছেন। কট্টরপন্থী ওহাবী জঙ্গীবাদ কোনদিনই বাংলার মাটিতে স্থান পাবে না। সুফিদের মাধ্যমে ইসলামের কল্যাণময় রূপটি বাঙালীর হৃদয়ে তাদের একানত্ম আপন লোকধর্মের রূপ নিয়েছে। আলস্নাহ ও রসুলের প্রতি আনুগত্য, সামাজিক সাম্য, মানবতাবাদ ও অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদই এই লোকজ বিশ্বাসের ভিত্তি। এ কারণেই স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গীরা সুফিসাধকদের পছন্দ করেন না। ইসলাম ও মানবতার শত্রম্ন জঙ্গীরা তাই হজরত শাহজালাল (র.) ও অন্য সাধক-দরবেশদের মাজারে বোমা হামলা চালিয়েছিল। এরাই ঢাকা মহানগরীতে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহর ভাস্কর্য অপসারণের জন্য আন্দোলন করেছিল। অথচ ইরান-ইরাকসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে কবি ও সাধকদের ভাস্কর্য সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গীরা কি উপলব্ধি করে না, একাত্তরে হানাদার পাকিসত্মানী বাহিনী ও তার সহযোগীরা সারাদেশে যে হত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা কখনই কোন ধার্মিকের কাজ নয়। ইসলাম কখনই এই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সমর্থন করে না। সুতরাং পাক হানাদার বাহিনী ও তাঁদের সহযোগী জামায়াত-শিবির অবশ্যই অধার্মিক ও ইসলামের শত্রম্ন। আমাদের শানত্মিপূর্ণ লোকধর্ম, লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতিকে রার জন্যই এই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের অবিলম্বে বিচার প্রয়োজন। এ বিষয়ে এতটুকু দেরি করা উচিত নয়।
সুফিসাধক ও কল্যাণময় ইসলাম ধর্মের প্রচারক হজরত শাহজালালের (র.) নামে ঢাকার আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের নামকরণ করে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার এ দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের মনের আশা পূরণ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, এই মহৎ কর্ম সম্পাদন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার অতিশয় সওয়াবের কাজ করেছেন। সুফিসাধক ও মহাপুরম্নষ হজরত শাহজালাল এদেশের প্রতিটি মানুষের বড় আপনজন। লৰ্য করে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এেেত্র এতটুকু ব্যতিক্রমী নন। তারা সবসময়ই সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.) এর মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে তাঁদের নির্বাচনী প্রচারণার সূত্রপাত করেছেন। আমার ধারণা, এই মহান সুফিসাধকের নাম ধারণের ফলে ঢাকার কুর্মিটোলা আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের গৌরব বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও হয়ত এই গৌরব হৃদয়ে ধারণ করবেন।
মোহাম্মদ সাদিক লিখিত 'সিলেট-নাগরী; ফকিরি ধারার ফসল' নামের এই অতিশয় মূল্যবান গবেষণামূলক বইটি পড়ার সময় আমার বারবার পুণ্যাত্মা হজরত শাহজালাল (র.) ও সিলেট শহরের গৌরবময় ইতিহাসের কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সিলেটসহ বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত, লোকসংস্কৃতি ও লোকঐতিহ্য নিয়ে গবেষণার মতো জাতীয় পর্যায়ে কোনো 'লোকসংস্কৃতি একাডেমী' এখনও গড়ে ওঠেনি। সংগ্রহের অভাবে দেশের কত লোকবাহিনী, লোকগান ও সুর যে বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে, তার কোন হিসেব নেই। সিলেট কিংবা ঢাকায় কি একটি আনত্মর্জাতিক মানের লোকসংস্কৃতি একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না? সিলেটের অমূল্য লোকসংস্কৃতি রৰায় সিলেটের গুণী মানুষেরা এগিয়ে আসতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ব্রাক-এর চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারম্নক চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে কিংবা ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যোগ নিলে সিলেটে সহজেই একটি আনত্মর্জাতিক মানের লোকসংস্কৃতি একাডেমী গড়ে উঠতে পারে। জীবনের সময় খুবই সীমিত, এ জীবনের বিলাস ও অর্থসম্পদ সব কিছুই অস্থাায়ী ; শুধু মহৎ কাজই স্মরণীয় হয়ে থাকে।
২০০৫ সালে আমি জীবনে প্রথম সিলেটে যাই। হজরত শাহজালালের মাজারে টিলায় উঠে অনেক কথাই মনে হয়েছিল। টিলার এক পাশে পরলোকগত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কবর। তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল অনেক পুরনো কথা। তিনি যখন এ পৃথিবীতে ছিলেন, তখন সাতাশ নম্বর রোডের 'মাহজাবীন' নামের বাড়িতে একটি বিকেল তার সানি্নধ্যে কাটিয়েছিলাম। তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি ও স্মৃতিচিহ্ন দেখিয়েছিলেন। সে সময় তাঁকে বড় সফল, সুখী ও পরিতৃপ্ত মনে হয়েছিল। তারপর তাঁর সাথে আর দেখা নেই। হজরত শাহজালালের (র.) মাজারে তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সহসাই মনে হয়েছিল হাছন রাজার সেই বিখ্যাত গান_'লোকে বলে বলেরে ঘরবাড়ি বালা না আমার। কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।' জীবনের সেই মরমী সত্যটিকে সেদিন নতুন ভাবে উপলব্ধি করলাম। মোহাম্মদ সাদিককে ধন্যবাদ। তিনি আমাদের লোকঐতিহ্যের এক অবলুপ্ত লিপির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
লোকজীবনই বাঙালীর রাজনীতি ও সংস্কৃতির মূল ভিত্তি। লোকজীবনকে ভিত্তি করেই বাঙালীর সুখী হওয়ার হাজার বছরের সাধনা। আমাদের পরিবেশ, কৃষ্টি, রাজনীতি অর্থনীতি, শিা সবই লোকজীবনের সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা কেউই যেন এ কথা ভুলে না যাই।

No comments

Powered by Blogger.