ফলনে কমছে দারিদ্র্য

উত্তরাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি দিনে দিনে বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র্যসীমার চেহারাটাও পাল্টে যাচ্ছে। এখন আর মৌসুমভিত্তিক আবাদ নেই। জলবায়ুর প্রভাবে কৃষক যখনই সুযোগ পাচ্ছে তখন যে ফসলই হোক তা নিয়ে মাঠে নামছে।
যে কারণে সময়ের ফসল অসময়েও মিলছে। পারতপ েকোন জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকছে না। পাঁচ বছর আগের যে জরিপে উত্তরাঞ্চলে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা লোকের সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ৫০ শতাংশ তা এখন কমে প্রায় ৩০ শতাংশে পেঁৗছেছে। এমনটি জানা গেছে কৃষি বিভাগের এক সূত্রে।
উত্তরাঞ্চলে বছর পাঁচেক আগেও খোরাকি অর্থনীতির আওতায় কৃষকের সংখ্যা ছিল বেশি (খোরাকি অর্থনীতি হলো শুধু নিজেদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্য যে অর্থনৈতিক কর্মকা-)। বৃহত্তর রংপুরের দু' একটি জেলা ছাড়া খোরাকি অর্থনীতির খোলস ভেঙ্গে নিজেদের চেষ্টায় বের হয়ে আসতে পেরেছে বড় অংশের দরিদ্র কৃষক শ্রেণী। বর্তমানে তাদের আর চরম দারিদ্র্যের ব্রাকেটে আনা যায় না। এখন আবাদের মাঠে ফসল উৎপাদনে ভর বছর যুদ্ধে নামে কৃষক এবং এই যুদ্ধে তারা (কৃষক) জয়ীই হয়। এদিকে দেশে দারিদ্র্যের হার কমাতে এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বড় বলয় সৃষ্টিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) মাঠে নেমেছে। দেশে এবারই প্রথম বর্গাচাষীদের ঋণ দেয়া হচ্ছে তাদের (চাষী) ঘরের দুয়ারে গিয়ে। আরেকদিকে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় এবারই প্রথম দেশের সকল কৃষক পরিবারের মধ্যে 'কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড' (যা কৃষকের পরিচয়পত্র হিসাবে পরিচিত) বিতরণ শুরম্ন করেছে। উত্তরাঞ্চলে এই কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৫১ লাখ ৪৭ হাজার ৩শ' ৩৬। এই কার্ডে প্রতিজন কৃষকের আবাদভিত্তিক সকল তথ্যই থাকবে। এই কার্ড দেখিয়েই তারা সরকারের দেয়া সকল সহযোগিতা ও ভর্তুকি পাবেন। ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে বিশেষ করে সেচ ও সারনির্ভর বোরো আবাদের খরচ কমাতে ডিজেলচালিত সেচে এবার কৃষকের ভর্তুকির হার বাড়ান হয়েছে। ডিজেলে এই ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৩শ' ৫০ কোটি টাকা, তা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে নির্ধারিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৭শ' কোটি টাকা। প্রথমে কথা ছিল ুদ্র ও প্রানত্মিক শ্রেণীর চাষী তাদের জমির হিসাব অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমান ডিজেলে ভর্তুকি পাবেন। এখন আর এই অর্থ প্রতি লিটার ডিজেলের হিসাবে দেয়া হবে না। এখন নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ চাষীদের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী প্রদান করা হবে। বোরো আবাদে চাষীদের দুই ভাগ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, প্রথম ভাগে আছে ুদ্র ও প্রানত্মিক চাষী যাদের জমি আধা একরের কম এবং সর্বোচ্চ আড়াই একর। দ্বিতীয় ভাগে আছেন যাদের জমির পরিমাণ আড়াই একর থেকে সাড়ে সাত একরের মধ্যে। এই চাষীদের ৮শ' টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যনত্ম ভর্তুকি দেয়া হবে, যা তারা নেবেন কার্ড দেখিয়ে।
বোরো আবাদের এই সময়টায় মাঠের কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বর্গাচাষীদের ঋণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা ও ডিজেলে ভর্তুকি দেয়ায় এবারে বোরো আবাদের জমির পরিমাণ টার্গেটের চেয়েও বেশি হবে। বাড়বে গম ও ভুট্টার আবাদও। উলেস্নখ করার মতো বিষয়, এবার উত্তরাঞ্চলে আলুর আবাদও হয়েছে বেশি। টার্গেট ছিল ৩ লাখ ১ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়ে উৎপাদিত হবে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন। ফসলের মাঠ জানান দিচ্ছে এর চেয়ে বেশি জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপন্ন হবে বেশি। যে রংপুরে আলুর আবাদ হতো খুব কম সেখানেও এবার হয়েছে আশাতীত ফলন। অবস্থা এমনই যে কুষক আলু আবাদ ঘরে তুলে বোরো আবাদে যাচ্ছে। এজন্য এবার বোরো চারা রোপণ কার্যক্রম কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বোরো আবাদের টার্গেট করা হয়েছে ১৬ লাখ ২২ হাজার ৪শ' ৯৪ হেক্টর জমি, এ থেকে চাল আকারে উৎপন্ন হবে ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার ৮শ' ৭৩ মেট্রিক টন। গম আবাদের টার্গেট করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি, উৎপাদিত হবে প্রায় ৬ লাখ ২৪ হাজার মে. টন। ভুট্টার টার্গেট করা হয়েছে ১ লাখ আড়াই হাজার হেক্টর জমি, উৎপাদিত হবে ৬ লাখ ৬৬ হাজার মে. টন। কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলে এবার রবি মৌসুমে প্রায় ২৮ লাখ হেক্টর জমিকে নানা ধরনের ফসলের আবাদের আওতায় আনা হয়েছে। তবে এর চেয়েও বেশি জমিতে আবাদ হবে, এমনটি আশা কৃষি বিভাগ ও মাঠের কৃষকের। মাঠের চিত্র বলে দেয়, প্রতিটি এলাকায় সবজির আবাদ হচ্ছে আশাতীত। এমন কোন কৃষকের বাড়ি নেই যেখানে সবজির আবাদ হচ্ছে না। কোন জমিতে চারটি করে ফসল হচ্ছে। চরের জমিতে হচ্ছে মরিচ, চিনাবাদামসহ নানা ফসল। জমি লিজের অঙ্কও বেড়ে গিয়েছে। বছর পাঁচেক আগেও যে জমি লিজ হতো ২ থেকে আড়াই হাজার টাকায় তা এখন ১০ হাজার টাকায় ঠেকেছে। কৃষি মজুরি দেড় শ' টাকা থেকে বর্তমানে আড়াই শ'/তিন শ' টাকায় ঠেকেছে। এই সময়টায় ফসলের মাঠে গিয়ে দেখা যায় বোরো আবাদের সকল প্রস্তুতি শেষ। গভীর ও অগভীর নলকূপের (শ্যালো) ভটভট শব্দ জানিয়ে দিচ্ছে সেচের বোরো আবাদের ধ্বনি। গভীর নলকূপ ব্যবহার হচ্ছে ১১শ' আর অগভীর নলকূপ ৬ লাখেরও বেশি, শক্তিচালিত পাম্প প্রায় ১১ হাজার। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কৃষক এখন মাঠে। বগুড়ার সোনাতলার কৃষক আজাহার বললেন, আগে শুধু খাবার নিয়ে চিনত্মা ছিল। এখন আর তা নেই। ঘরে ধান ওঠার পর ঘর গৃহস্থালি ও সংসারের খরচ করা যায়। শখের দুটো জিনিসও কেনা যায়। তার কথাতেই বোঝা গেল গ্রামের লোকের পার ক্যাপিটিয়া ইনকাম বেড়েছে।
_সমুদ্র হক, বগুড়া

No comments

Powered by Blogger.