‘অপূর্ণই থেকে গেল ওদের স্বপ্ন’

‘রুজির সময় হয়েছে পুত্রের, সেই সময় চলিয়া গেছে। বেতন পাইলে টাকা পাঠাইবো তারপর দেনা পরিশোধ করবো।’ এমনই কথা হয়েছে বড় ছেলের সঙ্গে ঘটনার আগের দিন শুক্রবার।
কথাগুলো বলেছেন চাঁদপুরের কচুয়ার সহোদরের পিতা শাহ আলম। তার দুই ছেলে শাহাদাৎ হোসেন ও টিটু  আহমেদকে হারিয়ে তিনি এখন বাকরুদ্ধ। কাঁদছেন আর কাঁদছেন। বললেন বড় ছেলে শাহাদৎ তার ছোট ভাইকে অল্প কয়েকদিন হয়েছে নিয়েছেন। ১১ মাসের শাওন। কিছুই বুঝে না। মায়ের  কোলে চড়ে বাবার লাশ নিতে এসেছে বিমানবন্দরে। নিহত মফিজুল ইসলামের স্ত্রী হালিমা আক্তার তন্নির এই অবুঝ শিশুটি। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। তন্নি তার সন্তানকে মানুষ করার জন্য সরকারের সাহায্য চেয়েছেন। পাশে বসে কাঁদছেন নিহতের বাবা জয়নাল। বুক ভরা স্বপ্ন ছিল তাদের। সহায় সম্বল বিক্রি করে, ধার কর্জ করে বিদেশে গিয়েছিলেন। ওরা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কঠোর পরিশ্রম করে উপার্জন করে সংসারের কষ্ট লাঘব করবে। সেই স্বপ্ন তাদের অপূর্ণই থেকে গেলো। ফিরে এলো লাশ হয়ে। ভেঙে গেল  ওদের স্বপ্ন। বাহরাইনে অগ্নিকাণ্ডে ওদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দেশের মাটিতে আসতে হয়েছে লাশ হয়ে। স্বজনদের চোখের জল ঝরিয়ে চির বিদায় নিলো। ওদের নিয়ে যারা স্বপ্ন  দেখছিলেন তাদের স্বপ্নও ভেঙে না ফেরার দেশে চলে গেছে তারা। বিমানবন্দরে স্বজনদের শোকের মাতন। বিমানবন্দরে লাশের অপেক্ষায়  প্রহর গুনছেন স্বজনরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইন থেকে কখন আসবে তাদের স্বপ্নের মানুষটির লাশ। সবার চোখে পানি। অঝোর ধারায় কাঁদছেন বাবা- মা, ভাই বা কারও স্ত্রী বা সন্তানরা। বাহরাইনের রাজধানী মানামার অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনায় নিহত ১৩ জন কর্মীর লাশ গতকাল। পৌনে ৭টার দিকে লাশ আসলেও মন্ত্রী এসেছেন ৭টা ৪২ মিনিটে। লাশের অপেক্ষা মন্ত্রীর জন্য। আমিরাত এয়ার লাইনের  ফ্লাইটে তাদের লাশ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫ জন, চট্টগ্রামের ৩ জন, চাঁদপুরের ৩ জন,  নোয়াখালী  ও কুমিল্লার একজন করে রয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন সহোদর ভাই। অগ্নিকাণ্ডে নিহতরা হলেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সাগির আহমেদের ছেলে নাজির আহমদ, পটিয়ার হাজী রশিদ আহমেদের ছেলে মাহবুব আলম এবং আবদুল আজিজের ছেলে জামাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের শহীদ মিয়ার দুই ছেলে সাইফুল ইসলাম সুমন ও স্বপন, আবুল বাশারের  ছেলে আনোয়ার, আবু নাসের মিয়ার  ছেলে জসিম, চাঁদ মিয়ার ছেলে জরু মিয়া। চাঁদপুরের কচুয়ার শাহ আলমের দুই ছেলে শাহাদাৎ হোসেন ও টিটু  আহমেদ, মতলবের আবদুস সাত্তার খানের ছেলে শাহিন খান, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির আবদুর রহিমের ছেলে ওসমান গণি, কুমিল্লা সদর দক্ষিণের জয়নাল উদ্দিনের ছেলে মফিজুল ইসলাম রয়েছেন। বিমানবন্দরে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরের সময় দাফন ও পরিবহনের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল থেকে প্রত্যেককে ৩৫ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। এরপর নিহতের পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদান দেয়া হবে। এছাড়া বাহরাইনে তাদের নিয়োগকর্তা হতে কর্মীর ক্ষতিপূরণ, বকেয়া, ইন্স্যুরেন্স আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে নিহতের পরিবারকে বৈধ ওয়ারিশগণের নাম, আনুষঙ্গিক বিবরণ ও ব্যাংক হিসাব নম্বর বিএমইটিতে জমা প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানো হয়েছে। বিমানবন্দরে লাশ গ্রহনের সময় উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের এমপি শাহ জিকরুল আহমেদ, চট্টগ্রাম পটিয়ার এমপি শামছুল হক চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব হযরত আলী, বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক  মাফরূহা সুলতানা, পরিচালক (কল্যাণ) মু. মোহসিন চৌধুরী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। উল্লেখ্য, চলতি মাসের ১১ই জানুয়ারি এই দুর্ঘটনা ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.