দেখলেই জিভে জল আসে, দ্রব্যগুণে ভরপুর চাষ হচ্ছে দেশের বাইরেও- তেঁতুলের আদ্যোপান্ত

তেঁতুল দেখার সঙ্গে সঙ্গেই জিবে (জিহ্বা) রস আসবে না এমন নারী পুরুষের সংখ্যা হিসাবের জন্য ক্যালকুলেটরের দরকার নেই। বিশ্বে তেঁতুল একমাত্র ফল যা দেখার সঙ্গেই মানব জিহ্বায় এক ধরনের সেলভিয়া (লালা) চলে আসে।
কেউ তো রীতিমতো চুকচুক শব্দে আহাউহু শুরু করে দেয়। বিজ্ঞান বলে, মানব দেহে প্রতিদিন ১ দশমিক ৭ লিটার থেকে ২ লিটার লালা উৎপন্ন হয়। দিনের কোন ভাগে তেঁতুল সামনে থাকলে এর পরিমাণ আরও খানিকটা বেড়ে যায়। তেঁতুলের অত্যধিক দ্রব্যগুণ ও ঔষধিগুণের জন্যই প্রকৃতি মানুষের মধ্যে তেঁতুল আকৃষ্টের ক্ষমতা দিয়েছে, এমনটিই বলেন প্রকৃতিপ্রেমী মাসুদুর রহমান। বাদামি রঙের একেকটি লম্বা চ্যাপ্টা পাতলা আবরণের মধ্যে ৬ থেকে ১২টি চেম্বারে থাকে চকলেটের মতো ঘন লালচে রঙের ফল তেঁতুল। যা থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে গাছের ডালে । প্রতিটি গ্রামে একাধিক তেঁতুল গাছ দেখা যেত একটা সময়। তেঁতুল গাছ নিয়ে আছে কতই না মজার গল্প। মধুর রোমান্টিকতাও আছে তেঁতুলকে নিয়ে। হৃদয়ের মানুষকে কাছে পাওয়ার আকুলতায় তেঁতুল ‘হিপনোটাইজের’ কাজ করে। আগের দিনের রসায়নের শিক্ষার্থীরা প্রেম গড়ার ক্ষেত্রে তেঁতুলকে বলত ‘ক্যাটালিস্ট’। এভাবে তেঁতুল পেত অনুঘটকের ভূমিকা। তেঁতুলের আজ আর সেই দিন নেই, সেই অবস্থাও নেই। গল্পগুলোও হারিয়ে গিয়েছে। তেঁতুল গাছও একই পথে। পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকা ও উপকূলীয় এলাকায় মিষ্টি তেঁতুল গাছের দেখা মেলে। সমতল ভূমির উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল ছিল টক তেঁতুলপ্রধান এলাকা। এখন টক তেঁতুল গাছের দেখা মেলে না সহজে। তেঁতুল মিষ্টিই হোক আর টকই হোক তেঁতুলের প্রতি মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ চিরন্তন এবং সহজাত প্রবৃত্তি। বিশ্বের চিকিৎসা শাস্ত্রে তেঁতুলকে নিয়ে হালে নানা ধরনের গবেষণা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করেই বলছেন, একমাত্র তেঁতুলেই আছে সবচেয়ে বেশি এ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা মানব দেহের জন্য অতি প্রয়োজন। মিষ্টি তেঁতুলের স্বাদ জানা নেই অনেকের। তেঁতুল বলতেই টক এমন ভাবনা দেশের প্রায় সকলের। মিষ্টি তেঁতুলের স্বাদ এবং টক তেঁতুল সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দেন বগুড়া হর্টিকালচারের উদ্যান তত্ত্ববিদ মাসুদুর রহমান। বললেন, আম্রপলি আমের যে ধরনের স্বাদ মিষ্টি তেঁতুলের স্বাদ তেমনই। রসায়নের হিসাবে মিষ্টি মান বা ব্রিক্স ভ্যেলু ২৬। টক তেঁতুলেও মিষ্টি মান আছে তার সঙ্গে বাড়তি হিসেবে আছে অনেক গুণ। বিশেষ করে হার্ট ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীর কোলেস্টরেল কমাতে তেঁতুল গোলানো পানির জুড়ি নেই। হিট ও সান স্ট্রোকে, পা জ্বালা পোড়ায়, রক্তক্ষরণ কমাতে, ক্ষুধামন্দা দূর করতে তেঁতুল দ্রুত কাজ করে। অনুষ্ঠান পার্বনে ও নিমন্ত্রণে রিচ ফুড খাওয়ার পর এক কাপ তেঁতুল পানি শরীরের চর্বি কেটে দেয়। এর পাশাপাশি দ্রব্যগুণে মেটাল পলিশ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় তেঁতুল। তিনি জানালেন তেঁতুলের ঔষধি ও দ্রব্যগুণ বিবেচনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মেক্সিকোতে বাণিজ্যিকভাবে তেঁতুল গাছের চাষ শুরু“ হয়েছে। ভারতে বর্তমানে বছরে আড়াই লাখ মেট্রিক টন তেঁতুল উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী ৫ বছরে এই পরিমাণ দশগুণ বাড়াতে তারা প্রস্তুতি নিয়েছে। ট্রপিক্যাল অরিজিনের তেঁতুল গাছের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ট্যামারডাস ইন্ডিকা’। সুদান ও মরু অঞ্চল হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছে তেঁতুল। সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয় দক্ষিণ এশিয়াতেই। তেঁতুল গাছের সংখ্যায় থাইল্যান্ড এগিয়ে। সে দেশের সেথিহাবুন প্রদেশের জাতীয় গাছ তেঁতুল। স্থানীয় ভাষায় নাম মাকাম। রাজধানী ব্যাংকক নগরীতে অতিথি আপ্যায়নে তেঁতুল আবশ্যিক। জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালোয়েশিয়া, ফিলিপিন্স ও মিয়ানমারেও তেঁতুল রাজকীয় ফলের মর্যাদায় অভিষিক্ত। বাংলাদেশে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একমাত্র তেঁতুল প্রতিটি ঘরে কোন না কোনভাবে পৌঁছে গেছে। তেঁতুলের বীজ বের করে কয়েকটি তেঁতুল একত্রিত করে হাতের মুঠোয় ভরে মুড়ির মওয়ার মতো করে শহরে, গ্রামের হাট বাজারে, মেলায় বিক্রি হতে দেখা যায়। বেশিরভাগ গৃহিণী তেঁতুলের আচার বানাতে এক্সপার্ট। তবে আচারের আগে কিছুটা পাকা তেঁতুল বইয়ামে ভরে রাখতেও ভুল করে না। কাজের অবসরে এই তেঁতুলই তাদের এনার্জি এনে দেয়। সমাজ জীবনে নবপরিণীতার কোলে নতুন অতিথি আগমনের ‘সিগনিফিক্যান্ট’ বা সঙ্কেত দেয় তেঁতুল। বাংলা চলচ্চিত্রে সামাজিক গল্পে পরিচালক নায়িকার হাতে তেঁতুল দিয়ে তা জিহ্বায় ভরার একটি দৃশ্য চিত্রায়ন করে অনেক দৃশ্যের কথা বলে দিতেন। জহির রায়হান জীবন থেকে নেয়া ছবিতে এমন দৃশ্য রেখেছেন। তেঁতুলকে নিয়ে এত কথার শাখা প্রশাখারও বিস্তার করেছে এই বৃক্ষ। উদ্যান তত্ত্ববিদ মাসুদুর রহমান বললেন, তেঁতুল টকই হোক আর মিষ্টি হোক ওই গাছ সব অঞ্চলের মাটিতেই বেড়ে ওঠে। পথের ধারে ছায়া সুশীতল করার পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধক গাছ হিসেবেও তেঁতুল বড় ভূমিকা রাখে। উত্তরাঞ্চলে তেঁতুলের গাছের সংখ্যা কমে গিয়েছে। এই গাছ বাড়াতে বগুড়া হর্টিকালচার থেকে তিনি সকল ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছেন। বীজ বুনলে বেড়ে উঠতে সময় নেয় ৮ থেকে ১০ বছর। তবে কলম করলে চার বছরের মধ্যেই ফল ধরে। ১৮ থেকে ২০ মিটার উঁচু প্রতিটি গাছে সাধারণত বছরে ১শ’ ৭৫ কেজি করে তেঁতুল ফলে। জানুয়ারি থেকে মার্চেই ফলন থাকে। এর ফুল অনেকটা হলদেটে ধরনের। তেঁতুল বাঙালীর জীবনের ঘনিষ্ঠাতায় জড়িয়ে আছে। বর্তমান প্রজন্ম নানি-দাদিদের কাছ থেকে অনেক গল্পের মধ্যে তেঁতুলের গল্পও শোনে। ঘরে যখন দেখে সেই তেঁতুল কোন না কোন জায়গায় লুকিয়ে আছে তখন বলার অপেক্ষা রাখে না বাড়ির কর্তা ঘরে তেঁতুল না আনলেও তেঁতুল ঠিকই ঘরে চলে আসে। তা যেভাবেই হোক।

No comments

Powered by Blogger.