নূরুল আমীন ও তার ভ্রান্ত রাষ্ট্রভাষা নীতি- এমএ বার্ণিক

শহরে যে নরহত্যা সংঘটিত হইয়াছে পুলিশ মিলিটারি যে জঘন্য আচরণ করিয়াছে তাহার জন্য দায়ী মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারই। এই হত্যাকাণ্ডের জওয়াব মুসলিম লীগকেই দিতে হইবে।
সেই কারণেই আমরা দেখিয়াছি যে, ব্যবস্থা পরিষদের বহু সদস্য পূর্ববঙ্গ লীগ পালামেন্টারি পার্টি হইতে পদত্যাগ করিয়াছেন। আমরা এই সমস্ত পদত্যাগী সদস্যকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি।" (সূত্র : দৈনিক আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।নূরুল আমীন একুশের ঘটনাবলীর পর দ্বিতীয় বার বেতার ভাষণ দেন ৩ মার্চ ১৯৫২ তারিখে। তার পুরো ভাষণটিই ছিল মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে দিয়ে যা করেছেন, তা কোনভাবেই নিজ কাঁধে নেননি। তার ভাষণটি ছিল নিম্নরূপ : আমি শোকাভিভূত অন্তঃকরণে বক্তৃতা দান করিতেছি। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় যে সমস্ত ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহা আমাকে গভীর আঘাত ও দুঃখ দিয়াছে। আমি আপনাদেরই একজন, আপনারা আমাকে প্রধান খাদিমের মর্যাদা ও সুযোগ দান করিয়াছেন। বিবেকের নির্দেশ অনুসারে যতদূর সম্ভব আপনাদের খেদমত করাই আমার কর্তব্য। বলাবাহুল্য যে, ছাত্র হোক বা না হোক সকল পাকিস্তানীর জীবনই অপর পাকিস্তানীর ন্যায় আমারও নিকট অতীব প্রিয়। উহা জাতির সম্পদ বলিয়াই আমি গণ্য করি এবং মনে করি যে উহার হানি যুগপৎ জাতীয় এবং ব্যক্তিগত তি। ঢাকার সাম্প্রতিক গোলযোগের ফলে যাঁহারা উপদ্রুত হইয়াছেন, আমার হৃদয় তাঁদের জন্য সহানুভূতিতে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। আমি পূর্বে বলিয়াছিলাম যে, সময়ে গুলিবর্ষণ সম্পর্ক পূর্ণতথ্য প্রকাশ করা হইবে এবং উহাতে যদি কাহাকেও দোষী বলিয়া দেখা যায়, তাহা হইলে সরকার তাহার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আকার ধারণ করিতেছে এবং গত কয়েকদিনের ঘটনায় যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা প্রশমিত হইতেছে, কাজেই এই সম্পর্কে শান্তভাবে ভাবিয়া দেখার সময় আসিয়াছে। জনস্বার্থের খাতিরে পূর্বেকার বিবৃতিতে আমি খোলাখুলি কিছু বলিতে পারি নাই। আমার মনে হয়, কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত সরকারের প েযে গত্যন্তর ছিল না, আপনারা যাহাতে তাহা বুঝিতে পারেন, সেই জন্য আর একটু খোলাখুলি আপনাদের নিকট কথা বলা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য কতিপয় কমিউনিস্ট ও অন্যান্য বিদেশী দালাল এবং অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে গভীর ষড়যন্ত্র চলিতেছিল, সরকারী ব্যবস্থার ফলে, তাহা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের পটভূমিকা ও উহার উদ্দেশ্য এবং ষড়যন্ত্রকারীদের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আমি কিছু বলিতে চাই।
যে সকল শক্তি পর্দার আড়ালে থাকিয়া চাবিকাঠি ঘুরাইতেছে, পূর্ববতর্ী বেতার ভাষণে আমি তৎসম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়াছি। ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখের অল্প পূর্বে সরকার সংবাদ পান যে, যাহারা পাকিস্তানের নাম পর্যন্ত শুনিতে পারিত না, যাহারা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে তাহাদের কণ্টকস্বরূপে মনে করিয়াছে এবং যাহারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করিয়া ফেলার চিন্তা কখনও মন হইতে দূর করিতে পারে নাই, তাহারা গূঢ় উদ্দেশ্য তৎপর হইয়া উঠিয়াছে।
আমরা ইহাও জানিতাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে গোলমাল রহিয়াছে। অনিষ্টকারী দল আমাদের ছাত্রদিগকে ভুলপথে পরিচালিত করিয়াছে এবং গোলমাল বাধাইবার জোর চেষ্টা করিতেছে। দেশে গোলমালের সৃষ্টি এবং শাসন ব্যবস্থাকে জোরক্রমে বানচাল করিয়া দিবার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা চলিতেছিল। তাহারা শুধু সুযোগের প্রতীায় ছিল। কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাতের জীবদ্দশায় তাহারা নিষ্ক্রিয় ছিল। কায়েদে মিল্লাতের শাহাদৎ তাহাদিগকে যে সুযোগ আনিয়া দেয় এবং ভাষা সমস্যাটি আমাদের ভাবপ্রবণ ছাত্র সমাজ ও জনসাধারণের মনকে আকৃষ্ট করে বলিয়া ইহার আড়ালে নিজেদের দুরভিসন্ধি লুকাইয়া রাখে। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.