আগরতলা যেন প্রাণের কাছাকাছি হাবিবুর রহমান স্বপন

অনেক দিনের ইচ্ছা আগরতলা যাওয়ার। এই আগরতলার মানুষজনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সকল প্রকার সহযোগিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাই তাঁকে বিশাল নেতায় পরিণত করেছিল।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ভারতের একটি রাজ্যের রাজধানী। কোন রাজ্যের রাজধানী এত কাছে আর নেই। আরও একটি আগ্রহ এই ত্রিপুরা রবীন্দ্রনাথের খুবই প্রিয় ছিল। এ কারণেই তিনি ৭ বার ত্রিপুরা গিয়েছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছে আগরতলার মানুষরা আমাদের বাংলাদেশীদের মতোই অতিথিপরায়ণ। কলকাতার বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেয়ে ওরা বাংলাদেশীদের বেশি প্রিয়। ওরা কথা বলে ঢাকাইয়াদের মতো এবং কুমিল্লার মানুষের ভাষায়। খাদ্যাভ্যাসও আমাদের মতোই।
ঢাকার কয়েক সাংবাদিক সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে আগরতলা যাওয়ার একটি সুযোগ মিলল। ২৪ মে সকাল ৮টায় বিআরটিসি বাসে কমলাপুর থেকে আমরা রওনা হলাম। বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় আমরা আগরতলা পৌঁছলাম। প্রচ- গরম। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে বর্ডারে এসেছিলেন ত্রিপুরার প্রতিভাবান তরুণ কবি প্রদীপ মজুমদার। তার প্রাইভেট কার যোগে শহরের প্রধান সড়কে অবস্থিত হোটেল লংত্রাই’য়ে পৌঁছলাম। সুন্দর পরিপাটি হোটেলটি। তবে আমার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষের এয়ার কন্ডিশনারের বিকট শব্দ বিশ্রামের বিঘœ ঘটাল। সামান্য সময় বিশ্রাম নেয়ার পর প্রদীপ মজুমদার আমদের নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে আবার হোটেলে বিশ্রাম। সন্ধ্যায় এলেন ত্রিপুরার প্রবীণ প্রভাবশালী কবি-লেখক রাতুল দেব বর্মণ। তিনি আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটালেন এবং পরে আসবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন। কিছুক্ষণ পরেই এলেন আকবর আহম্মদ, শ্যামল ভট্টাচার্য, মৃদুল দেব রায় ও প্রবুদ্ধ সুন্দর কর। নিজেদের লেখনীতে এরা সকলেই ত্রিপুরায় স্থান করে নিয়েছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হলো। আমি অনেক কিছুই শিখলাম জানলাম। রাত ১১টা পর্যন্ত চলল সাহিত্যের আড্ডা। এয়ার কন্ডিশনারের বিকট শব্দে কোন রকম ঘুম হলো। যাকে বলা চলে ব্রেক বা ড্রপ ঘুম।
ভোর ৫টায় আগরতলার সূর্যোদয় দেখতে বেরুলাম। সড়কে যানবাহন নেই। সুন্দর পরিপাটি গাছপালায় ভরা শহরের কয়েকটি সড়কে হাঁটলাম। সকালের আগরতলা বেশ ভাল লাগল। সকাল ৮টার আগে দোকানপাট খোলে না কেউই। সাড়ে ন’টায় আগরতলা রাজ্য টেক্স বুক বোর্ডের সদস্য লেখক আকবর আহম্মদ এলেন তার গাড়ি নিয়ে। আমরা রওনা হলাম উদয়পুরের উদ্দেশে। উদয়পুর ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী। চার শ’ বছর আগে উদয়পুরেই ছিল ত্রিপুরার রাজধানী। অমরপুর থেকে রাজধানী উদয়পুরে স্থানান্তর করা হয়। এখানেই রয়েছে মাতৃমন্দির। যে মন্দিরে প্রতিবছর এক হাজার নরবলি হতো। ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের ইতিহাসের আলোকেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন রাজর্সী গল্প এবং বিসর্জন নাটক। উদয়পুর যাওয়ার পথে বিশালগড় বাজারে নামলাম। প্রায় প্রতিটি দোকানে দেখলাম বাংলাদেশী পণ্য। এর মধ্যে সাবান, সিগারেট, জুস ইত্যাদি। চা পান করে আবার রওনা হলাম উদয়পুরের উদ্দেশে। পথে আমরা নামলাম সিপাহীজলা ফরেস্টের সাফারি পার্কে। অনেক প্রকার হরিণ ও প্রাণী দেখলাম। খুবই কাছে যেয়ে দেখলাম মায়া হরিণ শাবক। সমান্তরাল ফসলের ক্ষেত ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি চলল টিলা পথে। বারোভাইয়া নামক স্থানে মহাসড়কের ধারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা যানবাহন ঠেকিয়ে যাত্রীদের বিশুদ্ধ জল এবং শরবত পান করাচ্ছিলেন। আমাদেরও দেয়া হলো। তৃষ্ণা নিবারণ হলো। সামনে অগ্রসর হলো আমাদের যানবাহন। দু’ধারে শাল-গর্জন বৃক্ষ। উঁচু-নিচুু পথ পেরিয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে টেপানিয়া ইকোপার্কে নামলাম। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ কবি বিমল বণিক ও অশোক দেব হাসি মুখে হাত বাড়ালেন। আমাদের দেখানো হলো ‘ট্রি হাউস’। গাছের ওপর ঘর। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর ওদের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হলো।
বিকেল ৪টায় আমরা পৌঁছলাম অমরপুর। এটি ত্রিপুরার প্রাচীনতম রাজধানী। ১১শ’ বছর আগে এটি ছিল ত্রিপুরার রাজধানী। এখানকার একটি গল্পাবলম্বনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন মুকুট নাটক। ত্রিপুরার বিশিষ্ট কবি সমরজিত সিংহ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন পর্যটন কর্পোরেশনের গেস্ট হাউসে। বিশাল দিঘীর উত্তরে মনোরম পরিবেশে সুন্দরতম গেস্ট হাউসটির আসবাবপত্র সবই বাংলাদেশের একটি আসবাবপত্র প্রতিষ্ঠানের। বিকেল বেলাটা আমাদের ভালই কাটল। সন্ধ্যায় আমাদের সাথে যোগ দিলেন ভারতীয় একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক দৈনিক সকাল বেলার নির্বাহী সম্পাদক শ্যামল ভট্টাচার্য। তিনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আগরতলা থেকে অমরপুর গেছেন। সন্ধ্যায় অমরপুর বাজারের পাশে ছোট্ট একটি মাঠে নজরুল জয়ন্তী পালন অনুষ্ঠান। আয়োজক সমরজিত সিংহ। তিনি আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। অনুষ্ঠান বিলম্বিত হচ্ছিল বিদ্যুত না থাকার কারণে। প্রধান অতিথি বিধান সভার সদস্য মনোরঞ্জন আচার্য। অতিথির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন সমরজিত সিংহ। বিধায়ক মনোরঞ্জন আচার্য কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। তিনি অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার সময় আমাকে এবং কবি ওবায়েদ আকাশকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে মাইকে ঘোষণা করা হলো আমাদের নাম। আমরা বিব্রত হলাম। এর পরও আমাদের কিছু কথা বলতেই হলো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পীরা নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করলেন। ছোট ছেলেমেয়েরা সুন্দর গাইল। রাতে সমরজিত সিংহের বাড়িতে আমাদের উদর পূর্তি হলো। সমরজিত বাবুর স্ত্রী প্রীতি আচার্য খুব ভাল রাঁধুনি। তিনি কবিও বটে। অনেক রাতে ঘুমের জন্য বিছানায় গেলাম। বিদ্যুৎ বিভ্রাট আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। “ (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.