সৌরজগতের বাইরে চাঁদেও প্রাণের সম্ভাবনা এনামুল হক

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এতদিন সৌরজগত ছেড়ে সৌরজগতের বাইরেও বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান করছিলেন। এখন তারা সৌরজগতের বাইরে বাসযোগ্য চাঁদের সন্ধান করতে শুরু করেছেন।
কারণ এক নতুন গবেণায় দু’জন বিজ্ঞানী প্রমাণ দিয়েছেন যে, সৌরজগতের বাইরের গ্রহের মতো চাঁদগুলোতে প্রাণ ধারণের উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। জার্মানির পোটসডামের লাইবনিজ ইনস্টিটিউট ফর এস্ট্রোফিজিক্সের রেনি হেলার এবং ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ও নাসার এস্ট্রোবায়োলজি ইনস্টিটিউটের ররি বার্নেস ওই গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন। তাদের সেই গবেষণার ওপর একটি লেখা এস্ট্রোবায়োলজি ম্যাগাজিনের চলতি জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হবে।
বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরে প্রায় ৮৫০টি গ্রহের অস্তিত্ব জানতে পেরেছেন। এসব গ্রহের বেশির ভাগই গ্যাসের এক বিশাল আধার ও প্রাণহীন। আমাদের বৃহস্পতি গ্রহটি যেমন অনেকটা তেমনি। মাত্র কয়েকটি গ্রহের পৃষ্ঠদেশ কঠিন এবং এরা বাসযোগ্য অঞ্চলে থেকে নিজ নিজ নক্ষত্রকে পরিক্রমণ করে চলেছে। নক্ষত্র থেকে তাদের দূরত্ব এমন যে, এদের কঠিন পৃষ্ঠদেশে তরল পানি এবং প্রাণের অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান।
হেলার ও বার্নেস তাদের গবেষণায় এই প্রশ্নের তাত্ত্বিক জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন যে, সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর এমন চাঁদ থাকা সম্ভব কিনা যেখানে প্রাণের বাসযোগ্য পরিবেশ আছে। সৌরজগতের বাইরে কোন চাঁদ এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বলে এমন ধারণা করার কোন কারণ নেই যে, এ জাতীয় চাঁদ সেখানে নেই। গ্রহ থাকলে চাঁদও থাকবে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর আবহাওয়া ও জলবায়ুগত অবস্থা থেকে এই চাঁদগুলোর আবহাওয়া ও জলবায়ুগত অবস্থা ভিন্নরকম হওয়ারই বেশি সম্ভাবনা। কারণ এই চাঁদগুলো ভারি অদ্ভুতভাবে তাদের গ্রহের সঙ্গে জোয়ার ভাটার দ্বারা আবদ্ধ। কাজেই পৃথিবীর চাঁদের মতোই এসব চাঁদের একটি গোলার্ধ স্থায়ীভাবে গ্রহের দিকে মুখ করা। তাছাড়া চাঁদগুলোর আলোর দুটি উৎস আছেÑএক, নক্ষত্রের আলো। এবং যে গ্রহের চারপাশে এরা ঘুরপাক খাচ্ছে সেই গ্রহের আলো। এই চাঁদ গুলোতেও গ্রহণ হয়। এসব কারণে চাঁদগুলোর আবহাওয়ার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে পারে। হেলার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, সৌরজগতের বাইরে এমন একটি চাঁদের পৃষ্ঠদেশে দাঁড়ানো একজন পর্যবেক্ষক পৃথিবীতে আমাদের অভিজ্ঞতার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দিন ও রাত্রির অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। যেমন নক্ষত্রের গ্রহণের কারণে দুপুর বেলা হঠাৎ করে চাঁদটা পুরো অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারে।
হেলার ও বার্নেস সৌরজগতের বাইরের চাঁদে প্রাণের বাসযোগ্যতার মানদ- হিসেবে জোয়ারের উত্তাপকেও চিহ্নিত করেছেন। স্বাগতিক গ্রহের সঙ্গে চাঁদের দূরত্বের দ্বারা এনার্জির সেই বাড়তি উৎস নির্ধারিত হয়। চাঁদ যত কাছে থাকবে জোয়ারের তাপ তত বেশি হবে। সে সব চাঁদ তাদের গ্রহকে খুব কাছ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তাদের জোয়ারে প্রবল তাপ সঞ্চারিত হয়, যার কারণে এক বিপর্যয়কর গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ায় সেগুলোর পৃষ্ঠদেশের জলরাশি অধিক তাপে বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায়। পরিণতিতে চাঁদটি চিরকালের জন্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদ্বয় একটি তাত্ত্বিক মডেল উদ্ভাবন করেছেন যার সাহায্যে গ্রহের সঙ্গে চাঁদের ন্যূনতম দূরত্বটুকু কতখানি হলে চাঁদ তখনও প্রাণের বাসযোগ্য থাকতে পারে, সেটা হিসাব করে বলা যায়। প্রাণের বাসযোগ্য অবস্থা থাকতে পারে এমন এক ন্যূনতম দূরত্বকে বলা হয় ‘বাসযোগ্য সীমা।’ এই মডেলটির সাহায্যে ভাবীকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরের চাঁদগুলো বাসযোগ্য কিনা এবং হলে কতখানি তা নির্ণয় করতে পারবেন। বার্নেস বলেন, সৌরজগতের বাইরের চাঁদগুলোর একটি আবাসযোগ্য অঞ্চল আছে, যা গ্রহগুলোর বাসযোগ্য অঞ্চল থেকে সামান্য আলাদা।
সৌরজগতের বাইরে গ্রহ-উপগ্রহের সন্ধান সহজে বের করা সম্ভব হয়েছে নাসার কেপলার মহাকাশ টেলিস্কোপের বদৌলতে। এর সাহায্যে মঙ্গল থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সাইজের চাঁদ নিখুঁতভাবে বের করা যায়। ২০০৯ সালে মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হবার পর থেকে এই টেলিস্কোপটি বিজ্ঞানীদের সামনে সৌরজগতের বাইরের গ্রহ হতে পারে এমনি হাজার হাজার মহাজাগতিক বস্তুকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত যে সব গ্রহের সন্ধান নিশ্চিতভাবে জানা গেছে সেগুলোর বেশিরভাগই অতিকায় গ্যাসের পি-। তবে এদের চাঁদগুলোর বেশ কয়েকটি কঠিন আকার ধারণ করেছে এবং সেগুলোতে পানিসহ জীবনধারণ উপযোগী পরিবেশ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সৌরজগতের বাইরে প্রাণের বাসযোগ্য গ্রহের সংখ্যা যেখানে এ পর্যন্ত ১৬টি বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে এ জাতীয় উপগ্রহ বা তাদের সংখ্যা ধরা হচ্ছে ৩৫। গত ৩ জানুয়ারি পেশকৃত এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় বিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবী থেকে বেশ কয়েকশ’ আলোকবর্ষ দূরে সিগনাজ নক্ষত্র পুঞ্জে পিএইচ-২ নামে সূর্যের মতো ডে নক্ষত্রটি আছে তার পিএইচ-২ নামে একটি গ্রহের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। এই গ্রহের বায়ুম-লের শীর্ষভাগে গড় তাপমাত্রা হলো ৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আকার আয়তনে এটি হবে বৃহস্পতির মতো। এর অন্তত পক্ষে একটি চাঁদ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছেÑযা হবে গ্রহের আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ। এমন একটি চাঁদে যে পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে তাতে প্রাণের বাসযোগ্য অবস্থা থাকাই স্বাভাবিক।

No comments

Powered by Blogger.