আকাশ-মাটির মিতালী

আঁকাবাঁকা পথ, সবুজ পাহাড়, টিলা আর বিচিত্র নদী-ছড়া বেষ্টিত এক প্রাচুর্যময় জনপদ সুসং দুর্গাপুর। ভারত সীমানত্মের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নেত্রকোনার এক রত্নগর্ভা উপজেলা এটি।
মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যম-িত এ জনপদকে ঘিরে রয়েছে পর্যটনশিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। কিন্তু উন্নত যোগাযোগ ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিরাট এ সম্ভাবনাটি তেমন কাজে লাগছে না। উপরন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য অবলোকন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুরা। সরকারও হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব।
নেত্রকোনা শহর থেকে মাত্র দু'ঘণ্টার পথ পেরম্নলেই দুর্গাপুর। গারো, হাজং, কোচ, ডালু, বানাই, রাজবংশী ও অন্যান্য আদিবাসী অধু্যষিত এক পাহাড়ী জনপদ। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয়-একখ- ঘন কালো মেঘ যেন সেই কবে থেকে আকাশ-মাটির সঙ্গে মিতালী করে মিশে আছে। বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে উপজাতিদের বিরামহীন সংগ্রাম চলছে এখানে। কথিত আছে, গহীন জঙ্গল আর জীব-জানোয়ারের সঙ্গে মিতালি করে একসময় গারো আদিবাসীরা বসবাস শুরম্ন করেছিল বলেই এর নাম হয় গারো পাহাড়। 'সোমেশ্বর পাঠক' নামে এক ধর্মযাজক প্রথম দুর্গাপুরে সুসং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর বংশ পরম্পরায় রাজত্ব করেন আরও অনেকে। গারো বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, টঙ্ক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন ও হাতিখেদা আন্দোলন থেকে শুরম্ন করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যনত্ম বহু বিপস্নব-বিদ্রোহের নীরব সাী হয়ে আছে এককালের এই সুসং পরগনা।
দুর্গাপুরের সৌন্দর্য শুধু পাহাড়েই সীমাবদ্ধ নয়। ঘন সবুজ পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে সাদা, লাল ও বেগুনি রঙের চীনামাটি (সাদামাটি)। বিজয়পুরের এ খনিজসম্পদ দেশের সিরামিক শিল্পে প্রধান কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বিশাল এলাকাজুড়ে এই চীনামাটি আহরণের প্রক্রিয়াও মনোমুগ্ধকর, কাছে গেলে দর্শনাথর্ীরা চোখ এড়াতে পারে না। এছাড়া পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদীও যেন এক বিচিত্র ঝরনা ধারা। পাহাড়-নদীর অপরূপ মেলবন্ধন সেখানে। বর্ষায় এ নদী রাুসী রূপ নেয়। ভাসিয়ে দেয় বিসত্মীর্ণ জনপদ-ফসল। শুকনো মৌসুমে নদীর বুকজুড়ে থাকে কয়লা ও বিশাল বালিরাশি। সিলিকা (কাঁচ বালি) নামের এই বালিও নির্মাণশিল্পে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সোমেশ্বরীর দিগনত্মজোড়া বালিরাশি দেখেও মনে হয়, এ যেন আর এক সমুদ্রসৈকত।
ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে দুর্গাপুরে। সুসং রাজবাড়ি, কমরেড মণি সিংহের বাড়ি, টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত টঙ্ক স্মৃতিসৌধ, বহেরাতলি গ্রামের রাশিমণি স্মৃতিসৌধ, কমল রানীর দীঘি, রানীখং মিশনসহ অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শনের সমাহার এ জনপদ। এখানকার উপজাতিদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি- যা পরিচয় করিয়ে দেয় ব্যতিক্রম জীবনধারার সঙ্গে। উপজাতিদের সংস্কৃতি সংরণ ও চর্চার কেন্দ্র হিসাবে দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে রয়েছে সুদৃশ্য উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী। এ ছাড়াও উপজাতি অধু্যষিত গ্রামগুলোতে রয়েছে কারম্নকার্যম-িত ধমর্ীয় মন্দির, গির্জা ও উপাসনালয়। বিজয়পুর সীমানত্মে গড়ে উঠেছে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ স্থল শুল্ক বন্দর। ভারতের কিছু এলাকারও দেখা মিলবে দুর্গাপুর ওই সীমানত্মে দাঁড়ালেই।
দুর্গাপুরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য সারা বছরই দর্শনাথর্ীদের হৃদয় কাড়ে। তবে পিকনিকের স্পট হিসাবে শীত মৌসুমে সেখানে ভ্রমণবিলাসীদের ভিড় উপচেপড়ে। তাই শীত এলেই পাহাড়কন্যা দুর্গাপুর খুঁজে পায় পুরনো অতিথিদের সঙ্গে নতুন নতুন মুখ। অনেক বিখ্যাত পর্যটকও উপভোগ করে গেছেন দুর্গাপুরের সৌন্দর্য। দৃশ্যবন্দী করেছেন চিত্র নির্মাতারা। একটু কাছে গেলেই এর প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে আগন্তুকদের। ভাবিয়ে তুলে ভ্রমণবিলাসী, প্রকৃতিপ্রেমী, কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের। কিন্তু স্বাধীনতার আগেও যে তিমিরে ছিল দুর্গাপুর; আজও যেন তা ঠিক সে রকমই। উন্নত যোগাযোগ আর সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দুর্গাপুর এখনও এক উপেতি জনপদ।
ঢাকা, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনাসহ দেশের যে কোন প্রানত্ম থেকে দুর্গাপুরে যেতে হয় নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কের ওপর দিয়ে। যাতায়াতে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অপার সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসা দূর-দূরানত্মের ভ্রমণবিলাসীদের বিড়ম্বনার যেন আর অনত্ম থাকে না।
দুর্গাপুরের পর্যটন সম্ভাবনা সম্পর্কে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুল হোসেন আকঞ্জী জানান, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলে দুর্গাপুর মানেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। সরকারীভাবে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছকে আনলেই এটি হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় এক পর্যটন কেন্দ্র, যা সমৃদ্ধ করতে পারে জাতীয় আয়কেও।
অথচ অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি দুর্গাপুরকে আজও পর্যটন এলাকা হিসাবেই ঘোষণা করা হয়নি।
- সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা

No comments

Powered by Blogger.