সর্বত্র একই প্রশ্ন-বাচ্চু রাজাকার কোথায়

একাত্তরের মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল সোমবার এই দণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন যে যে প্রশ্নটি সর্বাগ্রে উঠে এসেছে তা হলো, দণ্ডিত ব্যক্তিটি কোথায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে বাচ্চু রাজাকার পলাতক। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য, তিনি পালিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থান করছেন। আবার আইনমন্ত্রী গতকাল বলেছেন, বাচ্চু রাজাকার কোথায় আছেন তা তাঁরা জানেন না।
দায়িত্বশীল ব্যক্তি-সংস্থার এমন পরস্পরবিরোধী তথ্যে বাচ্চু রাজাকারের অবস্থানস্থল নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটছে। রাজধানীতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি থেকে তিনি কিভাবে বেরিয়ে গেলেন? আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেও এমন একজন চিহ্নিত ব্যক্তি সীমান্তপথে ভারত হয়ে সুদূর পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন কিভাবে? তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি বাচ্চু রাজাকারের পাকিস্তানে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে থাকে তাহলে এত দিনেও ইন্টারপোলকে বিষয়টি জানানো হলো না কেন? সর্বোপরি পাকিস্তানে অবস্থানের পুরনো অবস্থানেই বিষয়টি আটকে আছে। পরবর্তী সময়ে কোনো অগ্রগতি নেই কেন?
গতকাল রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের গেটের সামনে অপেক্ষারত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা বাচ্চু রাজাকারের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় তাঁরা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম ব্যর্থতা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাচ্চু রাজাকারকে গ্রেপ্তারের জন্য আইনানুগভাবে সবই করা হচ্ছে।' ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কৌশলগত কারণে সব বলা যাবে না।'
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সানাউল গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে জানান, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে বাচ্চু রাজাকার পাকিস্তানের করাচিতে রয়েছেন। প্রথমে ভারত ও তারপর নেপাল হয়ে তিনি পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছেন। করাচির ঠিক কোন জায়গায় তিনি আছেন তা গোপন সূত্রে জানার চেষ্টা চলছে। তদন্ত সংস্থার এই কর্মকর্তা জানান, বাচ্চু রাজাকারকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে তিনি মৌখিকভাবে অনুরোধ জানাবেন।
যেভাবে পালালেন : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত বছরের ৩ এপ্রিল বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর ৯ এপ্রিল র‌্যাব সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের তৎকালীন মিডিয়া উইংয়ের প্রধান এম. সোহায়েল জানান, বাচ্চু রাজাকার ভারত হয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে পারেন বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তাঁর শ্যালক ও ছেলেসহ চারজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য মিলেছে। এম সোহায়েল জানান, পরোয়ানা জারির পরপরই বাচ্চু রাজাকারকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর বাসাসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালালেও তাঁর হদিস মেলেনি। পরবর্তী সময়ে তাঁকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি ও আভিযানিক কার্যক্রম বাড়ানো হয়। এক পর্যায়ে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু মিয়া পাকিস্তানে ভেগে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ৩০ মার্চ হিলি স্থলবন্দর এলাকায় গিয়ে হোটেলে অবস্থান নেন। এরপর ২ এপ্রিল তিনি অবৈধভাবে গোপনে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান। তাঁকে দেশত্যাগে সহায়তা করে তাঁর দুই ছেলে ও শ্যালকসহ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় ৯ এপ্রিল পুরান ঢাকা থেকে আটক করা হয় বাচ্চু মিয়ার ছেলে শাহ মোহাম্মদ ফয়সাল আজাদ ও আবুল কাশেম মুহাম্মদ মুশফিক বিল্লাহ জিহাদ এবং শ্যালক কাজী এহেতাসামুল হক লিটনকে (৪০)।
র‌্যাব কর্মকর্তারা সে সময় জানান, আটক তিনজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় ছোট ছেলে নিজেদের মাইক্রোবাসের পেছনের সিটের নিচে বাচ্চু মিয়াকে শুইয়ে নিয়ে পারিবারিক বন্ধু ড. ইউসুফের (প্রাক্তন অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়) আগারগাঁওয়ের বাসায় যায়। ১০/১৫ মিনিট অবস্থানের পর সেখানে গাড়ি পরিবর্তন করে ড. ইউসুফের মাইক্রোবাসের পেছনে বাচ্চু মিয়াকে একই কায়দায় শুইয়ে হিলি সীমান্তের উদ্দেশে রওনা হয় তারা। রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে তারা দিনাজপুরে বাচ্চু মিয়ার বন্ধু আবুল কাশেম আজাদের হোটেল 'ক্যাপিলা'য় ওঠে। ২ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে পরদিন শ্যালক কাজী এহতেশামুল হক লিটনের সঙ্গে বাচ্চু মিয়া ভারতে পাড়ি জমান। পরে সেখান থেকে মোবাইলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন ভাষ্য উদ্ধৃত করে গতকাল ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের যুগ্ম মহাসচিব সফিকুল বাহার মজুমদার টিপু। তিনি প্রশ্ন করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে থেকে বাচ্চু রাজাকার কিভাবে পালাল?

No comments

Powered by Blogger.