নীল সমুদ্র স্বচ্ছ জল নারকেলবীথি- অপরূপ সৌন্দর্য- দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন

বহুদূর হতে সাগর সঙ্গমে এসে দেখে যাও/ হে পথিক/ সর্পিল পথের দু'ধারে স্বপ্নীল সবুজ গিরি/ সাগর মেখলায় রম্নপোলি সৈকত এবং শুভ্র ফেনিল দুর্জয় কিরিট_ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জেটিতে নেমেই পর্যটকদের মনে গুনগুন করে ওঠে এমন কবিতা।
যারা কক্সবাজারের সমুদ্র দেখেছেন, তারা এক ঝটকায় সেন্টমার্টিনের তফাতটা বুঝে নেন। আনন্দে শিস দিয়ে ওঠেন 'একেই বলে ক্রিস্টাল কিয়ার।' নীল সমুদ্র। প্রবাল। গাংচিল। বালুর সৈকত পেরিয়ে সেন্টমার্টিনের নীল সমুদ্রের জলে পা রাখার পর তা স্পষ্টই দেখা যায়। স্বচ্ছ জলের নিচে বালুর দাগ, পাথর এমনকি মাছও দেখা যায়। সৈকত পেরিয়ে জলের কাছাকাছি এলে মনে হয়, কে যেন পাথর খ-গুলোকে পানিতে সযতনে বসিয়ে রেখেছে। কোথাও আবার আধকিলোমিটার পর্যনত্ম পাথরের স্তুপ পানির গভীরে যাওয়ার রাসত্মা করে রেখেছে। দ্বীপের অপর নাম 'নারিকেল জিঞ্জিরা'কে সার্থক করতেই যেন ২০ হাজার নারকেল গাছ এক অন্যরকম সৌন্দর্য তৈরি করেছে। এমন অপরূপ যে জায়গা সেখানেও সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে পর্যটনের কাঙ্ৰিত বিকাশ ঘটছে না। বছরের মাত্র পাঁচ মাস সেন্টমার্টিনে পর্যটকরা যাওয়ার সুযোগ পান। দ্বীপকে কেন্দ্র করে স্বার্থের সংঘাতে প্রশাসন ও দ্বীপের প্রভাবশালীদের মধ্যে অসনত্মোষ দানা বেঁধে উঠেছে। আর সাধারণের দাবি পর্যটক এখানে অতিথি, ভাগ্যলক্ষ্মী। কোন অবস্থাতেই যেন পর্যটকরা সেন্টমার্টিনবিমুখ না হয়।
টেকনাফ থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। নাফ নদী পেরিয়ে সাগরের উত্তাল ঢেউ কেটে জাহাজে বা সি-ট্রাকে করে পৌঁছাতে হয় সেখানে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত সেন্টমার্টিন সাড়ে ৭ কিলোমিটারের একটি ছোট দ্বীপ। নারিকেল জিঞ্জিরা নামেও এটি পরিচিত। সেন্টমার্টিনের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হলেও সেখানে পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার ৰেত্রে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। টেকনাফ থেকে যাত্রা শুরম্ন হয় সেন্টমার্টিনের পথে। সি ট্রাক ও জাহাজে করে সাধারণত শীত মৌসুমেই পর্যটকরা আসেন। গত সাত/আট বছর ধরে সেন্টমাটিনে পর্যটকের সংখ্যা আশাতীতভাবে বেড়েছে। শীতের সময় নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যনত্ম প্রতিদিন এক হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন যান। বাকি সাত মাসই উত্তাল সাগরের কারণে পর্যটক পরিবহনকারী জাহাজ চলে না। নিরাপত্তার কথা ভেবে পর্যটকরা আসেন না। সে সময়ে কোন জাহাজও থাকে না। পর্যটকদের ৯০ শতাংশই দেশী। এর মধ্যে ১০/১৫ শতাংশ বাদে বাকিরা দিনে দিনেই ফিরতি জাহাজে টেকনাফ ফিরে আসেন।
পর্যটকদের দারম্নণ আগ্রহ থাকলেও পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে সেন্টমার্টিনকে ঘিরে তেমন কিছুই করা হয়নি। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকদের জন্য নূ্যনতম কোন সুবিধা নেই। জেটি থেকে নেমেই প্রথম অব্যবস্থাপনা হিসেবে যা চোখে পড়ে তা হচ্ছে আবর্জনা। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে দ্বীপ ঘিরে বজর্্য ব্যবস্থাপনা একেবারেই নেই। ৩৬টি পাড়া নিয়ে গড়ে ওঠা দ্বীপে অধিবাসী আছেন সাড়ে ৫ হাজার। পর্যটকদের জন্য সাতটি মোটামুটি মানসম্মত বড় হোটেলের পাশাপাশি ১০/১২টি ছোট হোটেল রয়েছে। আর রেস্টুরেন্ট তো সারি সারি। প্রায় ২৫টি রেস্টুরেন্টই আছে। এর পরও এখন পর্যনত্ম সেখানে কোন বজর্্য ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়নি। হোটেল-রেস্টুুরেন্ট আর অধিবাসীদের ময়লা-আবর্জনা সব ফেলা হয় সমুদ্রে। এ নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথাও নেই। দ্বীপ ঘিরে পরিকল্পিতভাবে কোন পাকা রাসত্মা তৈরি করা হয়নি। বিশেষ করে জেটির আশপাশের হোটেলে ওঠা পর্যটকদের ধুলোবালির রাসত্মা পেরিয়েই চলাচল করতে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা বিদু্যত। সেখানে বিদু্যত নেই। পর্যটকদের জন্য হোটেল ব্যবসায়ীরা নিজস্ব জেনারেটরের মাধ্যমে বিদু্যতের ব্যবস্থা করেন। তবে রাত ১১টার পর আর বিদু্যত দেয়া হয় না। পুরো দ্বীপ ডুবে যায় অন্ধকারে। সেন্টমার্টিনের প্রত্যেক হোটেলেই রম্নমে রম্নমে মোমবাতি ও দিয়াশলাই দেয়া থাকে। বিদু্যত না থাকায় পর্যটকরা রাতে বিপাকে পড়ে যান। দ্বীপবাসীর দাবি, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হিসেবে সেন্টমার্টিনের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেয়া দরকার। পর্যটন শিল্প বিকাশে যত দ্রম্নত সম্ভব বিদু্যত, পানি, বর্জ্য সমস্যার সমাধান হতে হবে। পর্যটক বাড়াতে জাহাজের ভাড়াও কমাতে হবে। এখন একজনকে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যেতে নূ্যনতম এক হাজার টাকা জাহাজের ভাড়া দিতে হয়। যদিও ভাড়া সাড়ে তিন শ' টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
সেন্টমার্টিনকে রৰায় এখন সচেতনতা সৃষ্টির ওপরই জোর দিচ্ছেন বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সেন্টমাটিনের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। পর্যটনের অন্যতম আকর্ষর্ণীয় স্থান হলেও এটি ছিল ভীষণভাবে উপেৰিত। আমরা সেখানে ইকো টু্যরিজম গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছি। দ্বীপ রৰার জন্যই সেখানে স্থাপনা নিমর্াণে নিষেধাজ্ঞা আছে। নিয়ম সবার জন্য একই। তবে সরকারের সিদ্ধানত্ম দ্বীপের কিছু কিছু মানুষের মনঃপূত হচ্ছে না। সরকার কেন এমন উদ্যোগ নিচ্ছে তা তাদের উপলব্ধি করানোর জন্য সচেতনতামূলক পদৰেপ নেয়া হবে। দ্বীপ বাঁচাতে, দ্বীপের পরিবেশে ভারসাম্য রাখতে কেউ যেন বেড়াতে গিয়ে প্রবাল নিয়ে না আসেন সে আহবান জানিয়েও সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.