মীমাংসার ভার দুদকের! by টিটু দত্ত গুপ্ত ও আরিফুর রহমান

বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা না হলেও এখনই সব শেষ হয়ে যায়নি। উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ব্যাপারে এখনো কিছু সময় হাতে আছে বলে মনে করছে সরকার।
অনুসন্ধানদলের দেওয়া খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যালোচনা করছে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে একটু সময় লাগছে। তবে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রস্তাবের ব্যাপারে সরকার এক প্রকার শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সরকারের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুদকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ ক্ষেত্রে কার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে আর কাকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। দুদকের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বিশ্বব্যাংক যদি প্রকল্পে ফিরে আসে, তাহলে আইনি-প্রক্রিয়া ও সেতুর কাজ একসঙ্গে চলতে পারে। তবে এসব কিছু মেনে বিশ্বব্যাংক শেষ পর্যন্ত যদি না ফেরে, তাহলে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের বিকল্প উপায় খুঁজবে সরকার। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে দুদকের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকের পর সরকারের এ অবস্থানের কথা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন শীর্ষ পর্যায়ের একজন নীতিনির্ধারক।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও আশার কথা শুনিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কম্পানি লিমিটেড (ইডকল) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তিনি আরো বলেন, 'খবরের কাগজ যা-ই লিখুক না কেন, সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।'
বাংলাদেশের আইনের আওতায় যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাবে, দুদকই তাঁদের তালিকা তৈরি করবে এবং মামলা দায়ের করবে- ঢাকা ছাড়ার আগে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলটি এ বিষয়ে একমত হয় বলে তিনি দাবি করেন। দুদকের অনুসন্ধানদল তাদের খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছে মাত্র দুই দিন আগে এবং মামলা করতে আরো কিছু সময় লাগবে, এ বাস্তবতাও বিশেষজ্ঞ দলটি মেনে নেয়।
দুদকের অনুসন্ধানদলের খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে এখন বিচার-বিশ্লেষণ করছেন দুদকের চেয়ারম্যান, দুই কমিশনার এবং দুদকের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। শিগগিরই এ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে বলে গতকাল কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন আনিসুল হক। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার পরই তা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে পাঠানো হবে। এরপর প্যানেলের কাছ থেকে জবাব পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, 'বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি। আশা করছি, প্যানেলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হব।'
সূত্র জানায়, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলায় আসামি করা নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছতে পারেনি দুদক ও বিশেষজ্ঞ প্যানেল। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর বিশেষজ্ঞ প্যানেল থেকে বলা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তিনি দায় এড়াতে পারেন না। কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তিনি পুরোপুরি জানতেন। তাই তাঁকে মামলায় আসামি করতে হবে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে কারো কারো নাম বাদ দেওয়ার জন্য দুদককে চাপ দেওয়ার কথা অস্বীকার করে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক বলেন, তালিকায় পাঁচজন থাকবে, নাকি ১০ জন থাকবে, এটা সরকারের বিষয় নয়। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ আছে, এমন কারো নাম বাদ দেওয়ার কথা যেমন সরকার বলেনি, তেমনি কোনো প্রমাণ নেই এমন কাউকে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলবে না।
একই কথা বলেন দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আনিসুল হক। তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তির নাম ধরে আলোচনা হয়নি। শেষ দিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল দুদক আইন ২০০৪, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭, সরকারি ক্রয় আইন ২০০৬, সরকারি ক্রয় বিধিমালা ২০০৮-সহ সংশ্লিষ্ট কিছু আইন। এগুলোর খুঁটিনাটি, কোন অপরাধ কোন ধারায় পড়ে- এসব নিয়ে আলাপ হয়েছে। কারো নাম বাদ দেওয়া বা অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কথা হয়নি।
অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, মামলার ক্ষেত্রে সরকার বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যাবে, দুদক তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করবে। কাউকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের কোনো চাপ নেই।
মামলার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে কোনো মতবিরোধ হয়েছে কি না জানতে চাইলে বুধবার দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'সব সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। সেটা অবশ্যই দেশের আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী হবে। বিশ্বব্যাংক কী বলল, প্যানেল কী বলল, আমরা তা শুনব, বিবেচনা করব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বা আইনানুগ পদক্ষেপ হবে দেশীয় আইন অনুযায়ী।'
যত দুর্বলতাই থাকুক, জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের ওপর আস্থা রেখেই অগ্রসর হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন উন্নয়ন গবেষক ড. কে এ এস মুরশিদ। তিনি বলেন, 'সবাই মিলে এত দিন ধরে চেষ্টা করছে, এত সময় নষ্ট হয়েছে, এখন সবই শেষ হয়ে গেছে, এ কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। উভয় পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য একটা ফর্মুলা বের করা হবে- এ আশা করা ছাড়া উপায়ও নেই।'
বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞদল ওয়াশিংটনে গিয়ে কী প্রতিবেদন দেবে, এর ওপরই নির্ভর করবে সংস্থাটির পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে ফিরে আসা। বিশেষজ্ঞদলটির প্রতিবেদন স্বাধীন ও বাস্তবসম্মত হবে, এমনটিই আশা করেন ড. মুরশিদ। তিনি বলেন, 'তাদের তো ব্যক্তিগত এজেন্ডা থাকার কথা নয়। তারা রিজিড একটা অবস্থানে থাকবে, এটিও কাম্য নয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের প্রয়োজনটা তাদের বিবেচনায় রাখা উচিত। জাতীয় স্বার্থ ছাড়াও আমাদের যে সম্মানবোধ আছে, সে দিকটাও তাদের দেখা উচিত।'
দুদক, ইআরডি ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ করার পর দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছিল। তখন কোনো প্রমাণ দুদক হাতে পায়নি, সংবাদপত্রের খবরের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করেছে। এর সাত মাস পর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংক প্রথম কিছু প্রমাণ পাঠিয়ে এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে বলে সরকারকে। সরকারের ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হয়ে তারা জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। এরপর নতুন করে আলোচনার একপর্যায়ে শর্ত সাপেক্ষে এ প্রকল্পে আবার যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয়। দুর্নীতি তদন্তে অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে প্যানেল তৈরি করে বিশ্বব্যাংক।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র তদন্তে দুদকও আলাদা অনুসন্ধানদল গঠন করে। বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞদল ১৪ অক্টোবর ঢাকায় এসে দুদকের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই সময় দুদককে কিছু তথ্য দিলেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কোনো দালিলিক প্রমাণ প্যানেল থেকে পাওয়া যায়নি। তারা বলে গিয়েছিল, ১৫ দিন পর প্রমাণ পাঠানো হবে। সেই প্রমাণ দুদকের হাতে আসে ১৩ নভেম্বর। ওই দিনই দুদক ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে একটি গোপনীয়তা রক্ষা চুক্তি সই হয়, যাতে কোনো পক্ষই এখন এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ না করে। এ প্রমাণের ভিত্তিতে মাত্র ২০ দিনের অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৪ ডিসেম্বর দুদকের অনুসন্ধানদল তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। দুদকের অনুসন্ধানেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মিলেছে, এর সঙ্গে জড়িত আটজনের নামের তালিকাও রয়েছে প্রতিবেদনে। পরের দিন এ প্রতিবেদন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের সঙ্গে বৈঠকে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি বিশ্বব্যাংক ও দুদক। আলোচনা অমীমাংসিত রেখেই বুধবার রাতে ঢাকা ছেড়ে যান প্যানেলের সদস্যরা।
তবে আলোচনা একেবারেই ভেঙে গেছে বলে মনে করে না দুদক ও সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল। নামের তালিকা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে বলেও স্বীকার করে না তারা।
সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "দুদক বিশ্বব্যাংক প্যানেলকে বলেছে, 'তোমাদের এভিডেন্সের ভিত্তিতে আমরা অনুসন্ধান করেছি। গতকাল মাত্র রিপোর্ট তৈরি করেছি। কাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করব, আমরাই নির্ধারণ করব। যারা আমাদের আইন লঙ্ঘন করেছে, তাদের কাউকে বাদ দেব না।'" বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন বলে তিনি জানান।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব আবুল কালাম আজাদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছে। সেসব পরামর্শ পর্যালোচনা করছে দুদক। একই সঙ্গে অনুসন্ধানদলের প্রতিবেদন পর্যালোচনা চলছে। আশা করছি, বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হব।'
বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে বিশেষজ্ঞ প্যানেল কী প্রতিবেদন দেয়, এর ওপরই সংস্থাটির পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নির্ভর করছে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, 'আইনগত ব্যবস্থা তো দুদকই নেবে। বিশেষজ্ঞ প্যানেল যদি বলে যে দুদক তাদের পরামর্শ নিয়ে কাজটি করেছে, তাহলে তারা হয়তো ইতিবাচক প্রতিবেদন দেবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আরো দু-তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে।'
অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে নমনীয় অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেন এ গবেষক।
আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে দুদক
এদিকে অনুসন্ধানের পুরো বিষয়টি আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। গতকাল সন্ধ্যায় দুদক কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে গতকাল (বুধবার) দুই দফা বৈঠক হয়; যদিও তাদের ব্যস্ততার কারণে বৈঠকের সময়কাল সংক্ষিপ্ত ছিল। সে সময় তাদের নিশ্চয়তা দিয়েছি, তারা যেসব বক্তব্য দিয়েছে তা পর্যালোচনা করে পুরো বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাংলাদেশে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

No comments

Powered by Blogger.