পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ-এ সরকারের মেয়াদে শুরু করাই কঠিন byপার্থ সারথি দাস

নাটকীয় কিছু না ঘটলে মহাজোট সরকারের চলতি মেয়াদে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। সেতু বিভাগের সব ধরনের প্রস্তুতি থাকলেও বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মধ্যে এখন পর্যন্ত সমঝোতা না হওয়ায় প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যেই পড়েছে বহুল আলোচিত এ প্রকল্প।
২০০১ সালে পদ্মার মাওয়া প্রান্তে ভিত্তি স্থাপন করে যে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল, নানা জটিলতায় থমকে আছে তার অঙ্কুরোদ্গম।
সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের আগে প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে সুরাহা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেতু বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল সেতু নির্মাণের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে দরপত্র আহ্বান করা হলেও কাজ শুরু করতে কমপক্ষে ১০ মাস সময় চলে যাবে। দরপত্র আহ্বানের পর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিয়ম অনুযায়ী এই সময় লাগবে। আর এভাবেই পার হয়ে যাবে ২০১৩ সাল। যদিও সরকার নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিল।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বিশেষজ্ঞ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে গত রাতে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে চুক্তির পর্যায়ে যেতে কম করে হলেও আট মাস লাগবে। জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়কের কাজ হয়তো অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে প্রক্রিয়া শেষ করে শুরু করা সম্ভব হবে। কিন্তু মূল সেতু ও নদী শাসনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া শেষ করতে এর চেয়েও বেশি সময় লাগবে। তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাংক কী করছে, কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তা এখন দেখার বিষয়।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে- এমন অভিযোগ তোলে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর গত ২৯ জুন তারা ঋণচুক্তি বাতিল করে। অন্য তিন সহযোগী সংস্থা এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও বিশ্বব্যাংকের মতামতকেই গুরুত্ব দেয়। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মন্ত্রিসভায় প্রকল্পটি দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয় গত ৯ জুলাই। এরপর সেতু বিভাগ থেকে প্রাক-যোগ্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূল দরপত্রে অংশ নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। আবারও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করতে সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোভাবের কারণে দেশীয় অর্থায়নের বিষয়টি সামনে রেখে সেতু বিভাগ গত আগস্ট মাসে দরপত্র আহ্বানসহ বিভিন্ন কাজ শুরুর প্রস্তুতি নেয়।
মূল সেতু ও নদী শাসনের পাশাপাশি তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়াও নতুন করে শুরু করতে উদ্যোগী হয় সেতু বিভাগ। কানাডার এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ডভিত্তিক হালক্রো গ্রুপকে নিয়োগ দিতে প্রস্তুতি নেয় সরকার। হালক্রো গ্রুপ যমুনা সেতু প্রকল্পে তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছিল। এ অবস্থায় গত সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থায়ন প্রত্যাহারের আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। শুরু হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতির ষড়যন্ত্র অনুসন্ধানের তোড়জোড়। এ অবস্থায় সেতু বিভাগের সব প্রস্তুতিও থেমে যায়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সেতুর কাজ শুরুর আগে কিছু প্রস্তুতির জন্য আমরা একসময় একেকভাবে তৈরি হচ্ছি। কাজ কবে শুরু হবে, তা আমরা জানি না। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। কারণ ওপর থেকে বলা হয়েছে, আমরা যেন কথা না বলি।'
সেতু বিভাগ সূত্রে আরো জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমের বিশেষজ্ঞরা প্রকল্প কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন, ২০১০ সালের শেষ নাগাদ মূল সেতুর কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। ওই প্রতিষ্ঠানের নির্ধারণ করা সর্বশেষ সূচি অনুযায়ী, ২০১২ সালের মার্চ মাসে মূল সেতুর কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল।
উল্লেখ্য, প্রকল্পে মূল সেতু, নদী শাসন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস এলাকা নির্মাণ, নির্মাণকাজ তদারকি পরামর্শক নিয়োগসহ ছয়টি কাজের প্রাক-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল দুই বছর আগে। ওই সময়ে ছয়টি কাজের মধ্যে মূল সেতুর জন্য পাঁচটি, নদী শাসনের জন্য ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছিল সংশ্লিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। অন্যান্য দরপত্রের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছিল। সব দরপত্রের মূল্যায়ন শেষ করে সম্ভাব্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকাও তৈরি করা হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে প্রতিটি কাজের জন্য একটি করে ঠিকাদার চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করার কথা ছিল। গত বছর এসএনসি-লাভালিনকে তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যোগ্য বিবেচনা করে সেতু বিভাগ এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে নথিপত্র পাঠায়। কিন্তু এর পরই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রক্রিয়া ও তদন্তকাজের কারণে এ প্রকল্পে শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে। সময়মতো কাজ শুরু হলে এখন ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যেত।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এ যাবৎ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। প্রকল্প এলাকা মাওয়া ও জাজিরায় চারটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে পুনর্বাসন এলাকায় দুই হাজার ১০০ পরিবারকে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা রয়েছে সেতু বিভাগের। কিন্তু অর্থায়নের বিষয়টি ঝুলে থাকায় প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বড় অংশই হতাশ।
ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্পষ্ট হবে : যোগাযোগমন্ত্রী
এদিকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সেতু ভবনে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য জানান।
ওবায়দুল কাদের বলেন, 'পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ নিয়ে যে যা-ই বলুক, এ প্রকল্প ঝুলে গেছে তা বলার সময় এখনো আসেনি, এ জন্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।'

No comments

Powered by Blogger.