নাগরিক বিনোদন- মিউজিক ক্যাফের সুর-সন্ধ্যা by মাহফুজ রহমান

মিউজিক ক্যাফে। যেখানে সন্ধ্যা নামে গানের সুরে সুরে। ঢাকায় এমন রেস্তোরাঁ আছেবেশ কিছু। এগুলো চলে উষ্ণ কফির পেয়ালায় চুমুক, তুমুল আড্ডা—সুরের তালেতালে...
কবিতাকে স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিতে নিষেধ করছেন পুলক। ‘ক্রমান্বয়’ ব্যান্ডের ভোকাল পুলকের নিষেধ কি মানলেন কবিতা? ঢাকার বেইলি রোডের থার্টি থ্রি রেস্তোরাঁর পরিবেশ হঠাৎ করেই গেল পাল্টে। মনে হলো, আলো-আঁধারির মাঝে অদৃশ্য কবিতা এসে গেছেন! রেস্তোরাঁয় আসা সবাই নিশ্চুপ, তাঁরা নিশ্চয়ই কবিতার নামের কেউ একজনকে খুঁজে ফিরছেন।
কবিতাকে পাওয়া গেল কি গেল না, সে প্রশ্ন থাক। এসে গেলেন অনন্যা। যাঁর কথা ভেবে ভেবে শিল্পী উদাস হয়ে যান! জেমসের ‘কবিতা’ ও ‘অনন্যা’—এই দুটি গান দিয়েই শুরু হলো সুরমিশ্রিত নাগরিক সন্ধ্যা।
ঢাকায় আজকাল বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ কিংবা ক্যাফেতে সন্ধ্যা নামে গানের সুরে সুরে। সঙ্গে চলে উষ্ণ কফির পেয়ালায় চুমুক, তুমুল আড্ডা। কথা হচ্ছে মিউজিক ক্যাফে নিয়ে। যেখানে সান্ধ্যকালীন খানাপিনার সঙ্গে শোনা যায় লাইভ গান। গানের শিল্পী হিসেবে মঞ্চে থাকেন নতুন-পুরোনো ব্যান্ড কিংবা বয়সে নবীন অথবা নামজাদা কোনো শিল্পী।
তেমনই একটি ব্যান্ড ‘ক্রমান্বয়’, লেখার শুরুতেই যাদের গান নিয়ে কথা হচ্ছিল। থার্টি থ্রি রেস্তোরাঁয় এই ব্যান্ড গান পরিবেশন করছে পাঁচ মাস হয়। মাসে পাঁচ থেকে সাত দিন মঞ্চে ওঠেন ব্যান্ডের পাঁচ সদস্য। ভোকাল পুলক বললেন মিউজিক ক্যাফেতে গাওয়ার অভিজ্ঞতা, ‘এই মঞ্চে গেয়ে আমরা শ্রোতাদের আনন্দ দিই। আর আমরা পাই উৎসাহ-অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি ভালো একটা আয়ের পথও এটা। আমরা এখানকার ইন-হাউস ব্যান্ড।’
ইন-হাউস ব্যান্ড বলতে কী বোঝাচ্ছেন? বিষয়টি খোলাসা করলেন থার্টি থ্রির প্রধান ওয়েটার তাজউদ্দিন খান, ‘আমাদের এখানে নিয়মিত গান করে, এমন ব্যান্ড আছে প্রায় পাঁচটির মতো। এই ব্যান্ডগুলোর সঙ্গে আমরা চুক্তিবদ্ধ। এই ব্যান্ড বা শিল্পীদেরই আমরা বলি ইন-হাউস ব্যান্ড বা শিল্পী।’
থার্টি থ্রির মতো এমন বেশ কয়েকটি মিউজিক ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঢাকায়। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম উত্তরার ফায়ার অন আইস, বনানীর স্মোক মিউজিক ক্যাফে এবং ফিয়েস্তা ক্যাফে অ্যান্ড লাউঞ্জ। আছে গুলশানের রোডহাউস, বসুন্ধরা শপিং মলের চিলআউট মিউজিক ক্যাফে কিংবা ধানমন্ডির কজমো, দ্য স্টেজসহ আরও বেশ কয়েকটি।
মিউজিক ক্যাফে বিষয়ে এস আই টুটুলের অভিজ্ঞতা বেশ পুরোনো। ফিলিংস এবং এলআরবির সাবেক এই সদস্য হোটেল মিউজিক করছেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। আর এখন নিজেই পরিচালনা করছেন ফায়ার অন আইস নামের মিউজিক ক্যাফেটি। অভিজ্ঞতার কথা বললেন টুটুল, ‘নিঃসন্দেহে মিউজিক ক্যাফে বিনোদনের একটা ভালো মাধ্যম। রেস্তোরাঁয় খেতে এসে গান শুনতে পেলে সন্ধ্যাটা ভালো কাটারই কথা। অন্যদিকে নবীন শিল্পী এবং ব্যান্ডগুলোর জন্যও এটা ভালো একটা প্লাটফর্ম। আমার রেস্তোরাঁতেই নিয়মিত গান করেন সাত-আটজন তরুণ শিল্পী। এঁরা বেশির ভাগই পড়াশোনা করছেন। এখানে গাওয়ার ফলে তাঁরা যেমন আয়ের পথ খুঁজে পাচ্ছেন, তেমনই পাচ্ছেন শ্রোতা। গানের ফিডব্যাকটাও পাচ্ছেন তাৎক্ষণিকভাবে। এটা নতুন শিল্পী বা ব্যান্ডের জন্য বড় পাওয়া। মঞ্চভীতিও কাটে এতে।’ ক্রমান্বয়ের পুলকও একমত, ‘আমাদের দেশের বড় বড় ব্যান্ড—মাইলস, এলআরবি, সোলস, ওয়ারফেজ কিংবা ফিলিংস এভাবে গেয়ে এসেছে। বলতে পারেন, এই মঞ্চটা ক্যারিয়ারের ভিত গড়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখে। কারণ, এখানে চর্চাটা হয় বেশ ভালোভাবেই। আর সবাইকে নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গান করতে পারলে ভালো কিছু করা সম্ভব।’
অনেক জনপ্রিয় শিল্পীই গাইছেন মিউজিক ক্যাফেগুলোতে। তাঁদের মধ্যে আছেন আইয়ুব বাচ্চু, বাপ্পা মজুমদার, অর্ণব, হাবিব, ন্যান্সি থেকে শুরু করে কনা, হূদয় খান, বালাম কিংবা সন্ধিদের মতো শিল্পী। গান করে সিসটেমেটিক, বর্ণহীন, জাংশন, ফোর ব্রাদার্স আর ত্রিব্যঞ্জনের মতো নবীন ব্যান্ড। সংগীতশিল্পী কনার মতে, মিউজিক ক্যাফেতে মূলত শ্রোতারা আসেন গান শুনতেই, ‘খাওয়া-দাওয়ার মাঝে গান গাওয়াতে আপত্তি আছে। তবে মিউজিক ক্যাফেগুলোকে মানুষ আসে গানই শুনতে। তারই ফাঁকে চলে খাওয়া-দাওয়া। তাই এই ক্যাফেগুলোতে গান গাওয়া বেশ অন্য রকমের অভিজ্ঞতা। শ্রোতাদের একদম সামনেই পাওয়া যায়। তাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে।’
থার্টি থ্রিতে তন্ময় হয়ে গান শুনছিল তরুণদের একটা দল। তাঁদের একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আকিব হাসান বললেন, ‘গান শুনতে শুনতে এক কাপ কফি খাওয়ার অনুভূতিটা দারুণ। সন্ধ্যাটাই অন্য রকম হয়ে যায়!’ ঘড়িতে তখন ১০টা ছুঁই ছুঁই। ক্রমান্বয় গাইছে ‘যেখানেই যাও তুমি, থাকো যত দূর, এই গান পাড়ি দেবে প্রয়োজনে তেরো নদী, সাত সমুদ্দুর...’।

No comments

Powered by Blogger.