ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন ঝুলে গেছে! by শরীফুল ইসলাম

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া আবারও ঝুলে গেছে। ঈদের পরও ছাত্রদলের কমিটি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এ পরিস্থিতিতে সংগঠনটির নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী ছাত্রদল নেতাদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদলের নতুন কমিটি নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। এবারও তিনি লন্ডন থেকে ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারেক রহমান যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে কমিটি করা হলে এ নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলা হতে পারে বলে আঁচ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিজেই আন্দোলন-সংগ্রামে মূলদলের ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে পরিচিত বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচনের কাজে হাত দেন। ঈদের আগেই তিনি কমিটি ঘোষণা দেয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু এতে তাঁর ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান মনোক্ষুণœ হওয়ায় তিনি আপাতত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া থামিয়ে দেন।
নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের লক্ষ্যে সৌদি আরব যাওয়ার আগে গুলশান কার্যালয়ে ছাত্রদলের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে চার দিনব্যাপী বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। প্রথমবার ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার ২৮ জুলাই রাত সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত, তৃতীয়বার ২৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত এবং ৩০ জুলাই রাত সাড়ে ১০টা থেকে দুইটা পর্যন্ত ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেন তিনি। এসব বৈঠকে দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি মনোযোগ দিয়ে ছাত্রদল নেতাদের বক্তব্য শোনেন এবং তারপর তিনি তাঁদের উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে ছাত্রদলের পদপ্রত্যাশী নেতাদের উদ্দেশে সুস্পষ্টভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নেতৃত্ব পাওয়ার আশায় কোন ভাইয়া বা নেতার বাড়িতে ধর্ণা দিয়ে কাজ হবে না। সহ্য করা হবে না কোন তদ্বির-সুপারিশও। তিনি বলেছেন, যারা নেতৃত্বে আসতে পারে এমন নেতাদের সম্পর্কে সকল তথ্য বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে আছে। বৈঠকে উপস্থিত ছাত্রদল নেতাদের খালেদা জিয়া বলেন, মনে রাখবে, তোমাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে মাঠে আমার নিজস্ব গোয়েন্দা টিম কাজ করছে। নেতৃত্ব পাওয়ার আশায় কোন ভাই বা নেতার কাছে তদ্বির করা হলে তা নেতৃত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তদ্বিরকারীদের সম্পর্কে তদন্ত করা হবে। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে খালেদা জিয়া বলেন, তারেক রহমান অসুস্থ। সুস্থ হলে রাজনীতিতে ফিরবে সে। তার আগে নয়। তাই দূর থেকে তারেক রহমান ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের ব্যাপারে কোন সুপারিশ করলে তাতে অন্যদের প্রতি অবিচার হতে পারে। তাই তারেক রহমান কমিটির বিষয়ে কিছু বলবে না। এছাড়া তারেক রহমান এখন অসুস্থ, তাই রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাকে আগে সুস্থ হতে দাও। আর আমাদের পক্ষ থেকে যে কমিটি দেয়া হবে সেই কমিটির নেতৃত্ব মেনে নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। মনে রাখবে, সুপারিশ ও তদ্বিরের জোরে নতুন কমিটিতে কারও স্থান হবে না। কমিটির বিষয়ে কারও হস্তক্ষেপ মানা হবে না। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম, দলের প্রতি আনুগত্য ও যোগ্যতার মাপকাঠিতেই নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। ত্যাগী, মেধাবী ও দক্ষদেরই স্থান দেয়া হবে।
ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে খালেদা জিয়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের কর্মকা- না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিছু ঘটলে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। তাই ছাত্রদলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সক্রিয় হতে হবে। তিনি বলেন, আমি গত ১ জানুয়ারি কমিটি দেয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের কারণে সময়মতো কমিটি দিতে পারিনি। দীর্ঘ সময় নেতারা কারাগারে থাকায় দেরি হয়েছে। কিন্তু আর বেশি দেরি হবে না। হতাশার কোন কারণ নেই। সবার ভূমিকা সম্পর্কে আমি জানি।
ছাত্রদল নেতাদের উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া আরও বলেন, এ সংগঠন থেকে অতীতে অনেকে এমপি হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে। যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য এবং যাদের মধ্যে নৈতিকতা রয়েছে তাদের ছাত্রদলের নেতৃত্বে আনা হবে। খালেদা জিয়া আরও বলেন, কোন ভাইয়ার কথায় ছাত্রদল চলবে না। কোন বলয় বা অঞ্চলের কথায় ছাত্রদল চলবে না। আগামীদিনের আন্দোলন জোরদার করতে ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদে সাহসীদের স্থান দেয়া হবে। আর আন্দোলন জোরদার করতে প্রথমে ছাত্রদল ও পরে যুবদলে পরিবর্তন হবে।
ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, প্রত্যাশিত নতুন কমিটিতে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী প্রতিযোগী বেশি। এসব পদের জন্য যেসব ছাত্রনেতার নাম আলোচনায় শোনা যায় তাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম, সিনিয়র সহসভাপতি শহীদুল ইসলাম বাবুল, মহানগর দক্ষিণ আহ্বায়ক হাবিবুর রশিদ হাবিব, বর্তমান কমিটির বাইরে বিগত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, বিগত ঢাবি কমিটির হাসান মামুন, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আমিরুল ইসলাম শিমুল, আনোয়ারুল হক রয়েল, আবু সাঈদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক ওবায়দুল হক নাসির। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্বপ্রত্যাশীদের মধ্যে রাজিব আহসান, আকরামুল হাসান, আসাদুজ্জামান আসাদ, মাসুদ খান পারভেজ, মফিজুর রহমান আশিক ও সাদিউল কবির নীরবের নাম আলোচনায় রয়েছে।
সূত্র মতে, নতুন কমিটিতে স্থান পেতে ছাত্রদলের বেশ কয়েক নেতা লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করে এসেছেন। আবার কেউ কেউ তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এ খবর পাওয়ার পরই খালেদা জিয়া এবার ছাত্রদলের কমিটি গঠনের দায়িত্ব নিজে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, লন্ডন থেকে তারেক রহমান ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় থাকা বর্তমান কমিটির কিছু নেতা আবারও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে যাচ্ছে দেখে খালেদা জিয়া তারেক রহমানের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে তা থামিয়ে দেন এবং ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের দায়িত্ব নিজেই নেন। তবে খালেদা জিয়ার এই হস্তক্ষেপে তারেক রহমান ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যে কারণে ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঈদের আগে ঘোষণার কথা থাকলেও তা হয়নি। ঈদের পরও এ কমিটি হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.