চরাচর-অবহেলিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ by শরাফত হোসেন

'তিতাস একটি নদীর নাম'-এর লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলাদেশে অনেকটাই অবহেলিত। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসটি সমাদৃত হলেও অন্তরালেই পড়ে রইলেন এর স্রষ্টা। সংরক্ষণ করা হয়নি তাঁর জন্মভিটা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ গ্রামে মালোপাড়ায় লেখকের বাড়িতে এখন বাস করছেন সুনীল চন্দ্র বর্মণ ও তাঁর পরিবার।


নিকট প্রতিবেশী আছে চার-পাঁচ ঘর। সুনীল চন্দ্র বর্মণ জায়গাটি ক্রয় করেছেন বলে জানিয়েছেন।
এখানকার জেলেরা পেশা বদল করেছেন বাধ্য হয়ে। তাদের সন্তানরা স্কুল-কলেজে যায়। স্কুল চালায় এলাকারই মানুষ। নিজেদের সচ্ছলতা এসেছে আগের তুলনায়। খাইখরচ চলে নিজেদের উপার্জনেই। অথচ অদ্বৈত মল্লবর্মণের পড়ার খরচ চালিয়েছিলেন তখনকার জেলেরা মিলে। বিনিময়ে অদ্বৈত তাঁদের মাছের ব্যবসার হিসাব করে দিতেন। সে সময় মালো সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেত না, ধারণা করা হয়, অদ্বৈতই সে সময়কার মালোপাড়ার একমাত্র স্কুলগামী বালক। মালোপাড়ার কিশোর-যুবকরা অদ্বৈত মল্লবর্মণকে চেনে, তাঁর খ্যাতির কথাও তারা জানে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমী প্রতিবছর তাঁর জন্মদিবসে গোকর্ণ গ্রামে আলোচনা, গান, পথনাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠানের অয়োজন করে। এর আগে দু-তিন বছর অদ্বৈত মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এখন সে উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ত্রিপুরায় সরকারিভাবে জানুয়ারির ১-৩ তারিখে তিন দিনব্যাপী পালন করা হয় অদ্বৈত মল্লবর্মণ জন্মোৎসব। সেখানে শিল্প-সাহিত্যে অবদানের জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমীকে ২০১২ সালের উৎসবে অদ্বৈত স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ত্রিপুরা সরকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে ২০০৪ সালে। গোকর্ণ গ্রামে অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি সংসদ নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বর্তমানে এটিও বিলীন হয়ে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কালীবাড়ি মোড় থেকে গোকর্ণ ঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের নামে করার দাবি এলাকার মানুষের। এ বছর অদ্বৈতর জন্মদিবসে তাঁর জন্মভিটার সামনে স্থানীয় কিন্ডারগার্টেনের দেয়াল ঘেঁষে নির্মিত একটি আবক্ষ ভাস্কর্য উন্মোচন করা হয়। জেলা প্রশাসকের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় জেলা পরিষদ বাস্তবায়ন করে আবক্ষ ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ। ফলে জন্মভিটায় অদ্বৈতের স্মৃতি রক্ষার প্রাথমিক কাজটি দীর্ঘদিন পর হলেও সম্পাদন হয়েছে।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার গোকর্ণ গ্রামে, ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি এক দরিদ্র মালো পরিবারে। তাঁর বাবার নাম অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ। অদ্বৈতরা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন। ভাই-বোনদের মধ্যে তাঁর অবস্থান দ্বিতীয়। আর্থিক অনটনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি তিনি। অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করে কুমিল্লার মুরাদনগরের শ্রীকাইল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে চলে যান কলকাতায়, জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতা পেশায়। পেশাগত জীবনে কলকাতার 'ত্রিপুরা', 'নবশক্তি', 'দেশ', 'মোহাম্মদী', 'নবযুগ', 'কৃষক', 'দৈনিক আজাদ' ইত্যাদি সংবাদপত্রে কাজ করেন। 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছাড়া তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হলো- 'সাদা হাওয়া', 'সাগরতীর্থে', 'নাটকীয় কাহিনী', 'দল বেঁধে', 'রাঙামাটি' ইত্যাদি। অদ্বৈত পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়নকাল থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ছাত্রজীবনে অদ্বৈত কবিতা লিখতেন বেশি।
'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাস লিখে তিনি অর্জন করেন বিশ্বখ্যাতি। তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। ঋতি্বক ঘটক তা পরিচালনা করেন। ঋতি্বক ঘটক নিজে এবং সৈয়দ হাসান ইমাম, রোজি প্রমুখ এতে অভিনয় করেন।
আর এক বছর পর অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে।
শরাফত হোসেন

No comments

Powered by Blogger.