জঈশ-ই-মোহাম্মদের বাংলাদেশ প্রধান ঢাকায় গ্রেফতার

পাকিস্তানভিত্তিক ইসলামী জঙ্গী সংগঠন জঈশ-ই-মোহাম্মদের বাংলাদেশের অন্যতম সংগঠক মাওলানা মোঃ ইউনুসকে (৪৮) গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা চালানোর অভিযোগ রয়েছে।


দলীয় ও ব্যক্তিগতভাবে ইউনুসের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর যোগাযোগ রয়েছে। ইতোপূর্বেও অন্তত অর্ধশত বিদেশী জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশে দেশী জঙ্গী সংগঠন ও স্বাধীনতাবিরোধী এবং উগ্র ইসলামী দলগুলোর সহায়তায় জঙ্গী তৎপরতা চলছে।
শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (দক্ষিণ) বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার হাসান আরাফাতের নেতৃত্বে একদল গোয়েন্দা রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় মাওলানা ইউনুসকে। দুপুর ২টার দিকে মাওলানা ইউনুসকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখায় সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির মিডিয়া সেলের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নুরুন্নবী ও মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি মুখপাত্র ডিবির দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃত রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মাওলানা ইউনুসকে গ্রেফতার করা হয়। মাওলানা ইউনুস কক্সাবাজারের মৌলভীর কাটা আলগিভারী আদর্শ দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক। অভিযোগ করা হচ্ছে, শিক্ষকতার আড়ালে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন জঈশ-ই-মোহাম্মদের সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিল।
মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সাবের আহম্মেদ পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনটির অন্যতম আদর্শিক নেতা। মূলত অধ্যক্ষ সাবেরের মাধ্যমেই মাওলানা ইউনুস জঈশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় ১০ বছর আগে সাবের আহম্মেদ পাকিস্তান চলে যায়। সেখান থেকেই কলকাঠি নাড়ছে সাবের আহম্মেদ। পাকিস্তানে অবস্থান করেই মাওলানা মোঃ ইউনুসের মাধ্যমে বাংলাদেশে জঈশ-ই-মোহাম্মদের কার্যক্রমের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে সংগঠনটিকে সংগঠিত করতে আর্থিক ও আদর্শিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে মাওলানা সাবের।
মাওলানা ইউনুস কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গা ও কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে জঈশ-ই-মোহাম্মদের প্রসার লাভের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। তাকে বাংলাদেশে জঈশ-ই-মোহাম্মদ ও অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। ইউনুস পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠনটির সংগঠক হিসেবে রামুতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জঈশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছিল। সাবের ও ইউনুসের সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর যোগাযোগ রয়েছে। ইউনুস জামায়াতের এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশেই ঢাকায় এসেছিল। জামায়াতের সঙ্গে ইউনুস ও সাবেরের দলীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ রয়েছে। জামায়াতের অনেক শীর্ষ নেতাই পাকিস্তানে গিয়ে মাওলানা সাবেরের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নূর হাবা ও নূর আহমেদকে জাল পাসপোর্টসহ গ্রেফতার করা হয়। তারাও ইউনুস সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে।
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত শক্তি এদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটাতে থাকে। বিশেষ করে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিদেশী জঙ্গী সংগঠনের জোর তৎপরতা শুরু হয়। এদেশে ঘাঁটি গাড়তে থাকে বিদেশী জঙ্গী সংগঠনগুলো। দেশে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশী-বিদেশী জঙ্গীরা কাজ করছে। এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতেই সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়।
অভিযানের ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ২৭ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব গুলশান কুমার হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জেলপলাতক আসামি ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড আব্দুর রউফ দাউদ মার্চেন্ট গ্রেফতার হয়। এরপর মাফিয়া ডন ছোট শাকিলের সহযোগী জাহিদ শেখ গ্রেফতার হয়। তাদের তথ্যমতে, গ্রেফতার হয় ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড ও আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যেবার শীর্ষ নেতা মুফতি মাওলানা ড. ওবায়দুল্লাহ। ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের ৫ কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষতার আড়ালে জিহাদী ভাই (জঙ্গী) তৈরি করছিল। তাকে গ্রেফতার করতে ভারতের কয়েক হাজার কমান্ডো হেলিকপ্টারযোগে অপারেশন চালিয়েছিল। ওবায়দুল্লাহর তথ্যমতে, ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গী লস্কর-ই-তৈয়্যেবার অন্যতম সংগঠক ২৫ বার আফগান যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়া সমরাস্ত্র ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ মাওলানা মোঃ মনসুর আলী ওরফে হাবিবুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে এদেশে বসবাস করে জঙ্গী তৈরি করছিল। গ্রেফতারকৃতরা প্রকাশ করে দেয় বাংলাদেশে লস্কর-ই-তৈয়্যেবা, জঈশ-ই-মোহাম্মদ, জঈশ-ই-মোস্তফা ও হুজির (হরকত-উল-জিহাদ) কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
গ্রেফতারকৃতদের তথ্যমতে, র‌্যাব ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নিউমার্কেট থানার ৫৩/১ বসুন্ধরা গলির সুকন্যা টাওয়ারের ৫/এফ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে পাকিস্তানভিত্তিক আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠন জঈশ-ই-মোহাম্মদের উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ পাকি জঙ্গী রেজোয়ান আহম্মেদ, তার সহযোগী ইমাদ উদ্দিন ওরফে মুন্না, সাদেক হোসেন ওরফে খোকা, আবু নাসের মুন্সী ও বিমান ছিনতাইয়ে পারদর্শী নান্নু মিয়া ওরফে বিল্লালকে গ্রেফতার করে। দেশী-বিদেশী জঙ্গীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে দু’সহোদর জামায়াত নেতা সালাউদ্দিন ও বিএনপি নেতা মহিউদ্দিনকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব। গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের মূল শেকড় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোতে। তাদের কারণেই আজো বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা অব্যাহত আছে।

No comments

Powered by Blogger.