সার্ক-বিভেদের দেয়ালগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে by মহিউদ্দিন আহমদ

১৯৮০ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীরবিক্রম শাহ দেবকে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। রাজা বীরেন্দ্রর কাছ থেকে ইতিবাচক জবাব আসে।


তখন জিয়াউর রহমান একই ধরনের চিঠি পাঠান এই অঞ্চলের অন্য সরকারপ্রধানদের কাছে। সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে দেশগুলোর মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়। উদ্দেশ্য একটাই, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একটা আঞ্চলিক ফোরাম তৈরি করা।
১৯৮১ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের পররাষ্ট্রসচিবেরা প্রথমবারের মতো কলম্বোতে একটা সভায় মিলিত হন। শুরু হয় আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে নয়াদিল্লিতে সাতটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমবারের মতো একত্র হন। SAARC নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। আটটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
জনগণের জীবনমান উন্নত করা,
অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো
এবং যৌথ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা।
১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বসে শীর্ষ বৈঠক। ৮ ডিসেম্বর সাতটি দেশের শীর্ষ নেতারা সার্ক চার্টারে স্বাক্ষর দেন। এই ঐতিহাসিক বৈঠকটি হয় জাতীয় সংসদ ভবনে। সার্ক চার্টারের প্রথম বাক্যটি ছিল এই অঞ্চলে শান্তি স্থিতিশীলতা, সৌহার্দ্য এবং প্রগতি অর্জনের অঙ্গীকার।
ইতিমধ্যে ২৬টি বছর পেরিয়ে গেছে। এই আঞ্চলিক ফোরামে যোগ দিয়েছে আফগানিস্তান। ১০-১১ নভেম্বর মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই ২৬ বছরে সার্কের অর্জন কতটুকু।
পৃথিবীতে যতগুলো আঞ্চলিক গোষ্ঠী আছে, সার্ক হচ্ছে জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম। দক্ষিণ এশিয়ার মোট লোকসংখ্যা প্রায় ১৬০ কোটি। এই অঞ্চলটি আরও কয়েকটি কারণে স্বতন্ত্র। এটা এমন একটা অঞ্চল, যেখানে রয়েছে ধনী ও সম্পদশালী লোকের আবাস, আবার একই সঙ্গে এখানে বাস করে বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ। এই অঞ্চলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে মাথাপিছু সরকারি ব্যয় সবচেয়ে কম, আবার এটাই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক অঞ্চল। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া মানব রপ্তানিকারক এবং খাদ্য আমদানিকারক অঞ্চল। সোজা কথা, এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভিত এখনো অনেক দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ, তা আমরা যতই উন্নয়নের বড়াই করি না কেন।
একটি বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়া ‘সক্ষমতা’ অর্জন করেছে। গত বছর ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সরকারপ্রধানদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ওই সম্মেলনে মালদ্বীপের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, যিনি ছিলেন বয়সে সরকারপ্রধানের মধ্যে কনিষ্ঠতম, অভিযোগ করেছিলেন ‘টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স অব ব্রোকেন প্রমিজেস’ এই সাহসী উচ্চারণ করে। তিনি আঙুল তুলেছিলেন এ অঞ্চলের দুই বড় শরিক ভারত ও পাকিস্তানের দিকে। এই অভিযোগ নতুন নয়।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে আমার সুযোগ হয়েছিল নেপালের প্রথম কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী মনমোহন অধিকারীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার। কাঠমান্ডুতে তাঁর অফিসে বসে তিনি অনেক খোলামেলা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা অনেক কিছুই করতে চাই। কিন্তু ভারত আর পাকিস্তান ঝগড়া বাধিয়ে সব ভণ্ডুল করে দেয়।’ সাক্ষাৎকারটি ঢাকার দৈনিক ভোরের কাগজ-এ ছাপা হয়েছিল।
সার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা শুরু করার সময় এই অঞ্চলের নাগরিকেরা আশা করেছিলেন, পারস্পরিক বন্ধুতা ও সহযোগিতার একটা অনুকূল বাতাবরণ তৈরি হবে। কিন্তু তা হয়নি। সরাসরি যুদ্ধ (কারগিল) যদিও বা একবার হয়েছে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে অবিরাম। এই অঞ্চলের সরকারগুলো, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সব সময়ই জুজুর ভয়ে আক্রান্ত। আমাদের মনে আছে, একদা এ দেশের এক ‘গবুচন্দ্র মন্ত্রী’ বলেছিলেন, সাবমেরিন কেব্ল নেটওয়ার্কে যোগ দিলে আমাদের সব তথ্য পাচার হয়ে যাবে, আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। সে কথায় সায় দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। সুযোগটি নিখরচায় পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তী সরকার অনেক টাকা খরচ করে অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই বৈশ্বিক মহাসড়কে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেল। আমরা পিছিয়ে গেলাম অনেকগুলো বছর।
একটা বিষয় আমাকে খুব পীড়া দেয়। আমরা সহজে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারি না। আমরা যে কেউ নেপালে গেলে সেখানকার সীমান্তে বা এয়ারপোর্টে ভিসা সংগ্রহ করতে পারি বিনা আয়াসে। কিন্তু নেপালের কোনো নাগরিক বাংলাদেশে এ সুযোগ পান না। এখন নেপাল যদি আমাদের জন্য এই সুবিধাটুকু বন্ধ করে দেয়, আমরা কোন যুক্তিতে তার প্রতিবাদ জানাব?
এখন বাংলাদেশে ভারতের ভিসা পাওয়া কঠিন। পাকিস্তান সফরে গেলে ভারতীয়দের যাওয়ার পর একবার এবং ফিরে আসার আগে আরেকবার থানায় রিপোর্ট করতে হয়। পাকিস্তানিদের জন্য ভারতীয়দেরও একই রকম ব্যবস্থা। এখন বাংলাদেশের নাগরিকদেরও পাকিস্তানে গেলে থানায় রিপোর্ট করতে হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুশীলবেরা মনে করেন, ‘বিদেশি’ মানেই সন্ত্রাসী, জঙ্গি। তাঁরা এটা বুঝতে চান না, সন্ত্রাসীরা ভিসা নিয়ে সীমান্ত পার হয় না।
এমন একটা প্রেক্ষাপটে এবারের সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে যখন পৃথিবী অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত। এই অঞ্চলের দেশগুলো যেহেতু নিট আমদানিকারক দেশ, তাই এই মন্দার ভয়াবহতা এখনো প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যশস্যের দামের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, তা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশকে থামিয়ে দিতে পারে, সংকটাপন্ন হয়ে যেতে পারে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থান। এ সময়ে সবচেয়ে জরুরি হলো সমন্বিত আঞ্চলিক উদ্যোগ। এ জন্য প্রয়োজন আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার অর্থবহ প্রয়োগ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার।
এবারের সার্ক সম্মেলনের থিম হচ্ছে ‘জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ’। এই থিম অনুযায়ী জনগণের মধ্যে প্রণোদনা জাগাতে এবং এর সার্থক বাস্তবায়ন করতে হলে যে বিষয়গুলোর ওপর নজর দিতে হবে তা হলো:
১. জনগণের মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সব ধরনের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করা;
২. দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সব ধরনের অস্ত্রবাজি ধ্যান-ধারণা বিসর্জন দিয়ে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো;
৩. দেশগুলোর মধ্যে এবং দেশের ভেতরে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা।
এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দেশের সঙ্গে প্রতিটি দেশেরই কমবেশি সমস্যা আছে। অতীতের বিভাজনের রাজনীতি থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে এ সমস্যাগুলোর সিংহভাগ আমরা পেয়েছি, আর বাকি সমস্যাগুলো আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। আমরা জানি, সব সমস্যা যেমন এক দিনে তৈরি হয়নি, এক দিনে তার সমাধানও সম্ভব নয়। তবে উদ্যোগ তো থাকতে হবে।
১৯২০-এর দশকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের এক যৌথ সম্মেলনে মুসলিম লীগ সভাপতি হজরত মোহানি ‘ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের’ (United State of India) প্রস্তাব করেছিলেন। এটা ছিল একটা প্রফেটিক উচ্চারণ, যা ওই সময়ের নীতিনির্ধারকেরা আমলে নেননি। নিলে ইতিহাস অন্য রকম হতো। সেটি ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপট। এখন সময় এসেছে নতুন উপলব্ধির। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে আমরা একটা দক্ষিণ এশীয় যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা করতেই পারি। এতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের কৌলীন্যে ঘাটতি পড়বে না। আর গলাবাজি করে, চিরস্থায়ী দেয়াল তুলে সার্বভৌমত্ব সমুন্নত করা যায় না। আমাদের মধ্যে বিভেদের দেয়ালগুলো আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেলতে হবে। ‘বহুত্বের মধ্যে একতা’ (unity in diversity) এই আপ্তবাক্য তখন আর কল্পনাবিলাস মনে হবে না।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক, পিপলস সার্কের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.