চারুশিল্প-দারুশিল্পের দোহারা গড়ন by নন্দিনী মুখার্জি

প্রাচীনকাল থেকেই বৃক্ষের সঙ্গে মানুষের হূদ্যতার সম্পর্ক। শিকার থেকে শুরু করে বাসস্থান নির্মাণ এবং খাদ্য সংগ্রহের উৎস হিসেবে বৃক্ষের অবদান মাতৃসুলভ। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে কাঠের ব্যবহার বহুবিধ। যুগে যুগে এই প্রয়োজনের ধরন বদলে যাচ্ছে। কালক্রমে কাঠের তৈরি কাঠের কাজ শিল্পকর্ম হিসেবে তার শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। প্রধানত ধর্ম কেন্দ্রে কাঠের ব্যবহার দিয়ে এই শিল্পের আবির্ভাব।


তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শৌখিন জীবনের অলংকরণেও যুক্ত হচ্ছে দারুশিল্প। ভাস্কর্য, স্থাপত্য, মন্দিরের দ্বার-প্যানেল, কাঠের রথ, স্তম্ভ, মণ্ডপ, বসতবাড়ি, কারুকার্যমণ্ডিত আসবাব, গৃহসজ্জার নানা উপকরণে এই শিল্পের উৎকর্ষ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলায় কাঠের সহজলভ্যতা এই অঞ্চলে দারুশিল্পের বিকাশে সহায়ক ছিল। তবে আবহাওয়া ও স্থায়িত্বের দিক থেকে এই শিল্পের সুপ্রাচীন নিদর্শন খুব বেশি পাওয়া যায় না। বর্তমান সময়ে দারুশিল্পের ক্রমবিবর্তনে এই মাধ্যমের নানাবিধ উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। এখনকার শিল্পীদের এই শিল্পমাধ্যমের প্রতি নিরীক্ষাপ্রবণ মনোভাব নিশ্চিতভাবেই নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে চলেছে।
সম্প্রতি উত্তরার গ্যালারি কায়াতে শুরু হয়েছে শিল্পী রেজাউল ইসলামের ‘রেজুভেনেশন’ শিরোনামে উড এনগ্রেভিং প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীতে প্রায় ৪০টি দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে।
শিল্পী রেজাউল ইসলাম প্রকৃতির প্রতি ভীষণভাবে আচ্ছন্ন। তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্মে এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। ‘আমার বিষয় হিসেবে বাংলার প্রকৃতি-নারী-ফুল-লতা-পাখি বারবার এসেছে। আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি এ বিষয়টিতে। এখন আমি ইতালিতে বসবাস করি, তাই বাংলাদেশকে আরও নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারি। আমার শিল্পকর্মে এভাবেই বাংলাকে তুলে ধরি।’ শিল্পীর এই সরলতা তাঁর শিল্পকর্মেও রয়েছে। তিনি প্রকৃতির নানা বিষয় ও উপকরণকে আতিশয্য ছাড়াই সরল ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পকর্মে নারী ও পাখি অধিক মাত্রায় দেখা গেছে। তাঁর শিল্পকর্মে সব এলিমেন্টের উপস্থিতি সরল। নারী-পাখি-নদীর বাস্তব অবস্থা সমকালে এতটা সরলতায় অবস্থান করে না। এসব বিষয়ের প্রতি কিছুটা আর্কিওটাইপ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে এমন উপস্থাপনায় প্রণোদিত করেছে বলে মনে হয়।
টেরাকোটা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই মূলত আধুনিক উড এনগ্রেভিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। টেরাকোটায় মাটির চরিত্র প্রকটভাবে শিল্পের সাবলীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ এই সাবলীলতা উড এনগ্রেভিংয়ে দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে শিল্পী রেজাউল ইসলাম নিজস্বতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি কাঠের গড়নকে তাঁর নিজের মতো করে বিন্যাস ও বিস্তার করেছেন। টেক্সচারকে কাঠের প্রকৃতির ওপর ছেড়ে না দিয়ে নতুন করে তৈরি করেছেন আলাদা বুনট।
শিল্পী রেজাউল ইসলামের শিল্পকর্মে হাই ও লো রিলিফের ভেরিয়েশন লক্ষ করা যায়; বুননের ডাইভারসিটি এবং রং ব্যবহারে মার্জিত রুচির ছাপ তিনি স্পষ্ট করেছেন তাঁর কাজে। শিল্পমাধ্যমটিতে শিল্পীর দক্ষতা নিজস্ব গতিপথ তৈরির সব সম্ভাবনাসহ উপস্থিতি প্রকাশ করছেন। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার মুনশিয়ানায় তাঁর কাজগুলো দৃষ্টিসুখকর। তবে বিষয়ের উপস্থাপনার ভঙ্গিতে আরও বৈচিত্র্যের আশা করতেই পারেন সমসাময়িক শিল্পানুরাগী দর্শক। গতানুগতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করাই শিল্পীর অভীষ্ট বলে মনে হয়। অথচ এই মাধ্যমকে আরও বৈচিত্র্যময় করা যেতে পারে, শিল্পীর সেই দক্ষতা এবং যোগ্যতা দুটোই রয়েছে। এই মাধ্যমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বশিল্পে নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হবে বলে আশা করা যায়।
গ্যালারি কায়ায় এই প্রদর্শনী চলবে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.