সাংবাদিক দম্পতি হত্যা-অন্ধকারে তদন্ত কর্মকর্তারা, মিলছে না কোনো হিসাব by গোলাম মর্তুজা

সাংবাদিক দম্পতি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে অন্ধকারে হাতড়ে চলেছে পুলিশ। ছয় দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার কারণ বা খুনি সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পায়নি তদন্তকারীরা। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, সম্ভাব্য সব সূত্র ধরে তদন্ত কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
এ কাজে পুলিশ, র‌্যাব, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সিআইডির একাধিক দল মাঠে রয়েছে।
অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও ডিবির উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, এ ঘটনায় মামলায় কিছু লোককে সন্দেহ করছে পুলিশ। তাদের নিরীক্ষণে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনা-সংশ্লিষ্ট অনেকেরই বক্তব্য নেওয়া হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, ডিবির দুটি বিভাগের কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিহত দম্পতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত বা লেনদেন-সংক্রান্ত বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ রয়েছে কি না, তা তদন্তের শুরুতেই খতিয়ে দেখা হয়। আবার এটি চুরি-ডাকাতিজনিত ঘটনা কি না, এই সন্দেহকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ সন্দেহ সামনে রেখে গত মঙ্গলবার থেকে তদন্ত কার্যক্রমও বাড়ানো হয়েছে।
মেহেরুনের পারিবারিক সূত্র জানায়, ওই বাসা থেকে ঘাতকেরা সাগরের মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, একটি নেটবুক ও সোনার গয়না নিয়ে গেছে। মেহেরুনের মায়ের ধারণা, আলমারিতে ১০-১১ ভরি সোনার গয়না ছিল।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রথম চার দিন তদন্তকারীরা প্রযুক্তির ব্যবহার করে খুনি শনাক্তের চেষ্টা করে। এর ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি স্থানে অভিযানও চালানো হয়। এতে তেমন কোনো তদন্ত সূত্র মেলেনি। এরপর প্রথাগত ‘সোর্স-নির্ভর’ তদন্ত শুরু করে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার মতে, প্রথাগত তদন্তে অনিশ্চয়তা বেশি। তা ছাড়া এ ঘটনা গণমাধ্যমে যে আলোড়ন তুলেছে, তাতে খুনি নিশ্চয়ই অনেক সতর্ক হয়েছে। তাই তদন্ত আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
কোনো হিসাবই মিলছে না: সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাশ উদ্ধারের পর তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন, নিহত দম্পতির পূর্বপরিচিত বা স্বজনদের কেউ এ ঘটনায় জড়িত। পরে তদন্তে এ সন্দেহ অমূলক প্রতীয়মান হয়। তাই তদন্তকারীরা সন্দেহের তালিকা থেকে স্বজনদের বাদ দেন। এরপর মেহেরুন-সাগরের পরিচিত ব্যক্তি ও বন্ধুদের কয়েকজনের বক্তব্য গ্রহণ ও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে অনুসন্ধান করা হয়। শেষ পর্যন্ত এ সন্দেহের পক্ষেও জোরালো কোনো যুক্তি বা তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্রগুলো জানায়, আর্থিক লেনদেন বা পেশাগত কারণে নিহত দম্পতির সঙ্গে কারও বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাতেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া গ্রিল ভেঙে ফ্ল্যাটে চুরি বা ডাকাতির উদ্দেশ্যে ঢুকে দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে কি না, এ সন্দেহ এখনো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
খুনির প্রবেশ-বাহির: তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, খুনি কোন পথে ঢুকল ও কোন পথে বের হলো, তা নিশ্চিত হতে পারলে খুনি শনাক্ত করা সহজ হয়ে যাবে। বাড়ির দুই দারোয়ানকে আটক করে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করেও এ রহস্য উন্মোচন হয়নি।
সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পশ্চিম রাজাবাজারে ওই ভবনে ঢোকার একটিই পথ। লোহার ফটক সব সময় ভেতর থেকে লাগানো থাকে। ভেতরে সার্বক্ষণিক দারোয়ান। আছে অতিথি নিবন্ধন খাতা। ফ্ল্যাটের মালিকের সঙ্গে ঢুকলে বা অতিপরিচিত অতিথির নাম দারোয়ান নিবন্ধন খাতায় লেখেন না। নিবন্ধন খাতানুযায়ী, মেহেরুন-সাগরের ফ্ল্যাটে সর্বশেষ অতিথি তৌফিক। যিনি ঢুকেছিলেন ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে।
কিন্তু এখন প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় ফ্ল্যাটে কেউ ছিল না। ওই দিন সন্ধ্যার দিকে ছেলে মাহির সরওয়ারকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকেন মেহেরুন। আর রাত দুইটার সময় ঢুকেছিলেন সাগর। এ সময় মেহেরুন বা সরওয়ারের সঙ্গে আর কেউ বাসায় ঢোকেনি বলে পুলিশকে জানিয়েছেন ওই ভবনের দুই দারোয়ান ও এক কর্মী। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মেহেরুন মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিলেন।
তদন্ত সূত্রগুলো বলছে, মেহেরুন ও সাগরের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের জানালার ফোকর নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর ফুটোটা সবার নজরে আসে। জানালার গ্রিলের রডের জোড়া খুলে ফোকরটি তৈরি করা হয়। খুনি ওই ফুটো দিয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকেছিল কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, বাইরে থেকে ওই বাসার গ্যাসের পাইপ বেয়ে ওপরে উঠে জানালার ওই ফোকর দিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ ও বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ কাজে দক্ষ চোরেরা অনায়াসেই তা করতে পারে, যা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পাইপ বেয়ে সম্ভাব্য ওঠা-নামার ওই পথে দেয়ালে পায়ের ছাপসহ আরও কিছু আলামত পাওয়া গেছে বলে তদন্তকারীরা দাবি করছেন।
অবশ্য তদন্তকারীদের কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অর্থ-মালামাল লুট করতে আসা দুর্বৃত্তরা দুজনকে খুন করবে কেন? তা ছাড়া সাগরকে যেভাবে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা প্রচণ্ড আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আবার একটি ঘর ছাড়া আর কোনো ঘরে রক্তের দাগ নেই। বাকি কক্ষগুলো পরিপাটি অবস্থায় পাওয়া গেছে। খুনিরা রক্তমাখা পোশাকও ফেলে যায়নি। আবার প্রাপ্ত আলামতও উপেক্ষা করতে পারছেন না কর্মকর্তারা।
নিহত দম্পতির ছেলে পাঁচ বছরের মাহির পুলিশকে বলেছে, দুই ব্যক্তি তাঁর মা-বাবাকে খুন করেছে। সে ওই দুজনকে আগে একটি পিকনিকে দেখেছে। ওই দুজন চলে যাওয়ার পর সে দরজার ছিটকানি আটকায়। পরে নানিকে ফোন করে। ওই দুজন শিশুটিকে মারে বলেও সে জানিয়েছে। শিশুটির এ বক্তব্যও পুরোপুরি পরিস্থিতির সঙ্গে মিলছে না।
বক্তব্যের ঘনঘটা: ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারী শনাক্তের নির্দেশ দেন পুলিশকে। ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইমাম হোসেনসহ অন্য কর্মকর্তারাও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উদ্ঘাটনের আশা প্রকাশ করেন জোরেশোরে। ১৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় মহাপরিদর্শক (্আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, ‘তদন্তের প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’ পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আবারও বলেন, ‘যেকোনো মুহূর্তে এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দেশবাসী সুসংবাদ পাবে।’ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ মামলায় গণমাধ্যমের প্রচণ্ড আগ্রহ এবং চাপ রয়েছে। এটি তদন্তকারীদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশকে প্রতিদিনই গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু নতুন করে বলার কিছুই নেই। আবার পুলিশ গণমাধ্যমকে কিছু না বললে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও কর্মকর্তারা মনে করছেন।

No comments

Powered by Blogger.