খোলা চোখে-একুশ by হাসান ফেরদৌস

একুশ, তা দেশেই হোক বা বিদেশে, বাঙালিকে যেভাবে আন্দোলিত করে, অন্য আর কিছুই তা করে না। উদাহরণ হিসেবে বিদেশে আমার দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলব। দেশের বাইরে আমার প্রথম একুশ উদ্যাপনের অভিজ্ঞতা সাঁইত্রিশ বছর আগে ইউক্রেনের খারকভ শহরে। আমরা হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালি ছাত্র সে সময় খারকভে থাকি।


সে শহরে শহীদ মিনার নেই, আছে লেনিন স্মরণি, তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ। ফেব্রুয়ারি আসতে না আসতেই আমরা আলোচনায় বসলাম শহীদ দিবসে কী করা যায়। ঠিক হলো লেনিন বেদিতেই ফুল দেওয়া হবে একুশের প্রথম প্রহরে, ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে। ফেব্রুয়ারি মানে হাড়কাঁপানো শীত, দেড় ফুট বরফে মোড়া সারা শহর। প্রায় মাঝরাতে আমরা যখন ছাত্রাবাস থেকে বেরুলাম, সারা শহর তখন লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। গাড়ি-ঘোড়া চোখে পড়ে কি পড়ে না। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর মিলল প্রায় যাত্রীশূন্য একটি ট্রাম তার শেষ যাত্রী নিয়ে ডিপোতে ফিরছে।
আমরা জনা আষ্টেক বাঙালি ছাত্র সেই ট্রামে। সঙ্গে এক রুশ বন্ধু, আমাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে সেই হাড়কাঁপানো শীতেও সে এসে হাজির। তাজা ফুল পাইনি, অসম্ভব দাম, ফলে বাধ্য হয়ে কাগজের ফুলের মালা বানিয়ে এনেছি। ট্রাম থেকে নেমে নয়জনের মিছিল তৈরি হলো। সবার সামনে এক সতীর্থ সেই ফুলের মালা হাতে। বাকি সবাই পেছনে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে কিন্তু নির্দ্বিধায় সবাই গান ধরলাম, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।
কাগজের সে মালা ঠান্ডা বরফে মোড়া বেদিতে রাখতে গিয়ে যে রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম, এখনো তা স্পষ্ট মনে আছে। সবার চোখ অশ্রুসজল, কারও মুখে কোনো কথা নেই। যেন নিজের ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে আমরা। একসময় তার ভালোবাসার সরোবরে অবগাহন করেছি, তখন এসেছি তার স্বীকৃতি জানাতে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। শীতকাতর আকাশের নির্ঘুম তারা সাক্ষী, বিন্দুমাত্র খাদ ছিল না আমাদের সে পুষ্পাঞ্জলিতে।
২০ বছর পরের ঘটনা, নিউইয়র্কে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের উল্টো দিকে আমাদের অস্থায়ী শহীদ মিনার, মধ্যরাতে শ-দুয়েক বাঙালি কনকনে শীত উপেক্ষা করে ছেলেমেয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একুশের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে। এসেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, চাকরিজীবী, ট্যাক্সিচালক ছাত্র। সবার হাতে ফুল, কাগজের নয়, তাজা। মধ্য ম্যানহাটানে পুলিশের সতর্ক নজর সত্ত্বেও আমরা গান ধরলাম, কেউ কেউ নিজের দলের সপক্ষে স্লোগান তুলল। অস্থায়ী শহীদ মিনারে কে আগে ফুল দেব, তা নিয়ে কিঞ্চিত কথা-কাটাকাটিও হলো। প্রতিবছরই কম-বেশি একই অভিজ্ঞতা। শহরে বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে, ফলে আমাদের এই শহীদ মিনারে দর্শনার্থীও বাড়ছে। প্রথমে এই শহরে অস্থায়ী শহীদ মিনার ছিল একটি, এখন প্রায় এক ডজন। একটি স্থায়ী মিনার করা যায় কি না, তা নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা-চালাচালিও শুরু হয়েছে।
শুধু খারকভ বা নিউইয়র্ক নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালির বাস, একুশ তাদের চিরকাল সম্মিলিত করে, সংহত করে, উদ্দীপ্ত করে। সব বাঙালির অভিন্ন কোনো সিম্বল বা প্রতীক যদি থেকে থাকে, তো তা হচ্ছে এই একুশ। এমনকি স্বাধীনতা নিয়ে—কে তাঁর ঘোষক, কে তাঁর প্রধান সিপাহসালার তা নিয়ে আমাদের তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু একুশের সামনে কৃতজ্ঞতায় মাথা নোয়ায় না, এমন বাঙালি কোথাও নেই। আমি বলছি না একুশ নিয়ে দলাদলি নেই। ঢাকার শহীদ মিনারে ফটো ঝোলানো থেকে কে কী স্লোগান দেবে, তা নিয়ে তর্কাতর্কি তো বটেই, ঘুষাঘুষিও ঘটেছে বিস্তর। তাতে একুশের অবমাননা হয়েছে, কিন্তু তার সাধারণ স্বীকৃতির কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। আমাদের ইতিহাসে একুশের ইতিহাস ও একুশের স্থান নিয়ে কোনো মতভেদ বা দ্বিধা তাতে জন্মেনি।
কয়েক বছর আগে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেসকো একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর যেখানে যে থাকুক, এখন থেকে তার মাতৃভাষার উদ্যাপন হচ্ছে একুশ। আপনি জুলু বা খোসা, চীনা বা জাপানি যে ভাষাতেই কথা বলুন না কেন, নিজ ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের যোগসূত্র হচ্ছে এই একুশ। আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এই স্বীকৃতির বাহ্যিক কোনো গুরুত্ব হয়তো নেই, কিন্তু বাঙালি হিসেবে একুশের এই স্বীকৃতি আমাদের যৎকিঞ্চিত অহংকারী করে বৈকি।
নিজ ভাষার প্রতি আনুগত্য ভালোবাসা পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই রয়েছে। ভাষা রয়েছে বলেই তো আমি মানুষ। ভাষা নেই পশুর। অথবা অপূর্ণ কোনো মানুষের। হেলেন কেলারের কথা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। জন্মের ১৯ মাস পর থেকেই অন্ধ, বোবা ও কালা সেই আশ্চর্য মেয়েটা। শব্দের জগতের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে সাত বছর বয়সে শিক্ষিকা অ্যান স্যালিভনের মাধ্যমে। তিনি নিজেও অন্ধ কিন্তু ভাষার শক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। হেলেনের মা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ওকে প্রথমে কী শেখাবেন আপনি?
জবাবে অ্যান বলেছিলেন, সর্বপ্রথমে, সর্বশেষে এবং তার মাঝামাঝি সব সময় আমি কেবল একটি জিনিস শেখাব, তা হলো ভাষা।
শুধু ভাষা? বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন হেলেনের মা।
অ্যান স্যালিভন বলেছিলেন, হ্যাঁ, ভাষা, কারণ চোখের জন্য আলো যতটা দরকার, তার চেয়েও অনেক বেশি দরকার ভাষার।
উইলিয়াম গিবসনের নাটক দি মিরাকল ওয়ারকার-এ তাদের সে কথোপকথন ধরা আছে।
ভাষা মানুষের মনের মধ্যে যে প্রদীপ জ্বেলে ধরে, একুশ তাকেই উসকে দেয়। হেলেন কেলার আমাদের একুশের কথা জানতেন না, কিন্তু ভাষা নিয়ে তার মন্তব্য আমাদের একুশকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর কথায়, ‘ভাষার প্রতিটি শব্দই তাজা, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সংযুক্ত করে। ভাষার প্রতিটি শব্দ আমাদের চিত্তকে জাগরিত করে, তাকে আলো দেয়।’ হেলেন নিজে সে মুক্তি অর্জন করেছিলেন দীর্ঘ শ্রম ও গভীর ভালোবাসায়।
হেলেন কেলার যে মুক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন তার কারণ তিনি ভাষাকে পরিণত করেছিলেন হাতিয়ারে। শুদ্ধ জাগতিক অর্থেও ভাষার মাধ্যমে এই সাফল্য ধরা পড়ে। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকান, দেখবেন সবচেয়ে সমৃদ্ধ যে দেশ, নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারে সে সর্বাধিক অগ্রসর। তুরস্কের নবজাগরণের নায়ক কামাল আতাতুর্ক এই কথা একসময় চোখে আঙুল দিয়ে নিজের দেশের মানুষকে দেখিয়েছিলেন। এটা এমন এক সময়ের কথা যখন তুর্কি ভাষা লেখা হতো আরবি হরফে, যদিও তুর্কি ভাষা লেখা বা পড়ার জন্য সে ভাষা বা তার হরফ মোটেই বাস্তবসম্মত ছিল না। ১৯২৮ সালে ইস্তাম্বুলের এক উন্মুক্ত উদ্যানে তিনি দেশের নামজাদা সব বুদ্ধিজীবীকে এক সভায় আহ্বান করে তাঁর হাতে ধরা কাগজ থেকে তুর্কি হরফে লেখা একটি বিবৃতি পড়ে শোনানোর অনুরোধ করলেন। কিন্তু তেমন কোনো লোক না পাওয়া গেলে আতাতুর্ক তাঁর এক সহকারীকে দিলেন সে বিবৃতি পড়ে শোনাতে। তাতে লেখা ছিল:
‘এখন থেকে আমাদের তুর্কি ভাষা লিখিত হবে তুর্কি হরফে। যে বোধগম্যহীন চিহ্নে এত দিন আমাদের ভাষা লিখিত হয়েছে, তার দাসত্ব থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। আমাদের প্রত্যেককে তুর্কি হরফে নিজেদের ভাষায় লেখাপড়া শিখতে হবে, আর তা করতে হবে দ্রুত। এটা হবে আমাদের প্রত্যেকের জন্য দেশপ্রেম ও জাতীয় দায়িত্ববোধের প্রকাশ।’
কিন্তু এ কথাও ঠিক, ভাষার নিজস্ব ও নিরপেক্ষ কোনো গুরুত্ব নেই। মানুষ তাকে ব্যবহার না করলে সে কেবল উলুবনে ছড়ানো মুক্তো। ভাষা নদী নয় যে অনায়াসে প্রবাহিত হবে। সে বাতাস নয় যে নির্দ্বিধায় বয়ে যাবে। সে ফুল নয় যে প্রকৃতির নিয়মচক্রে প্রস্ফুটিত হবে। ভাষাকে তুলনা করা যায় হাতুড়ি বা শাবলের সঙ্গে। হাতে তুলে ব্যবহার না করলে তা দিয়ে ইট ভাঙা যাবে না, কাঠ কাটা যাবে না। এই হাতুড়ি-শাবলের ব্যবহারে যে যত আগ্রহী ও দক্ষ, সে তত সফল ও অগ্রসর। আমার ভয়, ভাষাকে হাতুড়ির মতো ব্যবহার করতে হয়—সে ব্যাপারটা আমরা বাঙালিরা ভুলতে বসেছি। একে তো ইংরেজির আক্রমণে বাংলা সিঁটিয়ে আছে। তার ওপর যে অবজ্ঞা ও অযত্নে এই ভাষার আমরা পালন করি, তাতে এ ভাষা সত্যি সত্যি শুকিয়ে কাঠ-কয়লা হলে অবাক হব না।
বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের অবজ্ঞার একটি উদাহরণ দেব?
মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে সরকারিভাবে নির্দেশ জারি করে বলা হয়েছিল শহীদ মিনারে একুশের প্রথম প্রহরে যাঁরা পুষ্পাঞ্জলি দেবেন, তারা দয়া করে শ্রদ্ধাঞ্জলি বানানটি শুদ্ধ করে লিখবেন। অর্থাৎ অঞ্জলিতে যেন হ্রস্ব ই-কার থাকে। এক দিন পর সকালের পত্রপত্রিকায় দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সবচেয়ে বড় যে ফুলের মালা এসেছে তাতে লেখা আছে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’, হ্রস্ব ই-কার নয়, দীর্ঘ ই-কার। লজ্জার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, নিউইয়র্কে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন, বছরের পর বছর দেখেছি অনেকে ওই ভুল বানানেই শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখে যাচ্ছেন। একে কী বলব—অজ্ঞতা, না মূর্খতা? নিজের ভাষার প্রতি যে উদাসীন, মানুষ হিসেবে সে চিরদিনই দরিদ্র রয়ে যায়। আমাদের বর্তমান হাল থেকেই সে কথা স্পষ্ট। বাংলাদেশে এখন অনেক শিশু অনায়াসে ইংরেজিতে লিখতে-পড়তে পারে অথচ নিজ ভাষার অক্ষরজ্ঞান তাদের নেই। দেশের পত্রপত্রিকায় পড়েছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পাঠদান করা হয়। তার কোনো কোনোটায় নাকি বাংলায় কথা বলা নিষিদ্ধ। আমলারা বাংলার বদলে অশুদ্ধ ইংরেজিতে নোট পাঠাচ্ছেন, এ তো আকসারই ঘটছে।
প্রবাসে বাঙালির নিজ ভাষার প্রতি অবজ্ঞা আরও কদর্য। এখানে ইংরেজি শব্দ অশুদ্ধ বানানে লিখলে লজ্জিত হই অথচ নির্দ্বিধায় অশুদ্ধ বাংলায় গল্প-কবিতা লিখে যাচ্ছি, তাতে কোনো লজ্জা নেই। নিজ ছেলেমেয়েরা ইংরেজি বললে আমরা কেউ কেউ বর্তে যাই অথচ তারা যে মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছে তাতে কোনো উদ্বেগ নেই। মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে এক একুশের অনুষ্ঠানে এক বঙ্গ-মার্কিন বক্তা বলেছিলেন, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে বেশি কিছু তিনি চান না, তারা ‘আব্বা’ বললেই তিনি খুশি। সে আহাম্মককে কে বোঝাবে যে ‘আব্বা’ শব্দটিও বাংলা নয়।
একুশকে আমরা বিশ্বসভায় পরিচিত করেছি, তা আমাদের গভীর গর্বের কথা। এই গর্ব অর্থবহ হবে যদি যে ভাষায় একুশ রচিত হয়েছে, তাকে আমরা বিশ্বসভায় পরিচিত করাতে পারি। দেশে কি বিদেশে যেখানেই থাকি না কেন, এ কাজে আমরা প্রত্যেকেই হাত লাগাতে পারি। আর কিছু না পারি, ভাষার হাতুড়িখানা তুলে ধরে তার সঠিক ব্যবহার তো শিখতে পারি।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.