দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক-ভারতকে প্রতিদান দিতে হবে

ভাবা হয়েছিল, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করবে। কিন্তু পাঁচ মাস গত হয়ে গেল, নয়াদিল্লি বড় মাপের ইস্যুগুলোর সুরাহায় ব্যর্থ। যে প্রীতি তারা পেয়েছিল, তা-ও খোয়ানোর পথে।


ভারতের ইউপিএ সরকারের জন্য যা হতে পারত জোরালো কূটনৈতিক অর্জন, তা আজ এমন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, যার কোনো প্রতিকার নেই। এখনই শুধরে না নিলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক যুগান্তকারী মুহূর্ত একেবারে বিফলে যাবে।
ভারত-বাংলাদেশের এই গল্পের সবচেয়ে বড় খলনায়িকা হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইউপিএ সরকারের এই অস্থিরমতি অংশীদার প্রথমে ঢাকা সফরে সঙ্গী হতে না চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে লজ্জায় ফেলে দেন। এটা ছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ। প্রস্তাবিত পানি বণ্টনের পদ্ধতি নিয়ে মমতা অসন্তুষ্ট হয়ে থাকলে তো দর-কষাকষির আরও সুযোগ ছিল। তা না করে শেষ মহূর্তে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে তিনি কেবল প্রধানমন্ত্রীকেই বিশ্রী অবস্থায় ফেলেননি, ঢাকার শেখ হাসিনা সরকারকেও বিব্রত করেছেন।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে সেই বিব্রতকর নাটকটাও যেন যথেষ্ট নয়। শোনা যাচ্ছে, তিনি সম্প্রতি ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করার ব্যাপারেও আপত্তি প্রকাশ করেছেন। এই চুক্তির সৌজন্যবিধি ঢাকা সফরের সময়ই স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সংসদে অনুসমর্থিত হয়ে গেলে, এই চুক্তির বলে ভারত তার দীর্ঘতম সীমান্ত চিহ্নিত করতে পারবে এবং উভয় রাষ্ট্র পরস্পরের অপদখলীয় ভূমি ও আটকা পড়া এলাকা (এনক্লেভ) ফেরত পাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি আর ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১টি আটকা পড়া এলাকা রয়েছে। কীভাবে এমনটা হলো, তা নিয়ে বেশ কিছু চটকদার গল্প প্রচলিত আছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে রংদার হলো— কোচবিহারের রাজা ও রংপুরের ফৌজদার দাবা খেলায় বাজি রেখেছিলেন কতগুলো গ্রাম। এতেই নাকি একের ভেতর আরেকের এলাকা ঢুকে যায়। ভারত ও বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়ার সময় মানচিত্রের এই ভুলগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে অমীমাংসিত অবস্থায় উভয়ের ভাগে পড়ে।
কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোর (এনক্লেভ) বাসিন্দাদের জীবন মোটেই মজার বিষয় নয়। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এসব এলাকায় নেই কোনো জরুরি অবকাঠামো, যেমন—বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও থানা। অধিবাসীরা যার যার দেশে যেতে পারে বটে, তবে এর জন্য সীমান্তরক্ষীদের অনুমতি নিতে হয়। সীমান্তরক্ষীরাও তাঁদের ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘুষ নেন, জন্ম দেন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের এক ব্যবস্থা। মাদক পাচার, মানব পাচারসহ গরু চোরাচালানের জনকও এই ব্যবস্থা।
সীমান্তে নিয়মিত গুলিতে মৃত্যুসহ বিভিন্ন নির্যাতনমূলক ঘটনা ঘটে, তারও কারণ এটাই। সম্প্রতি বিএসএফের হাতে চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির ওপর নির্মম নির্যাতনের একটি ভিডিও প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের মানুষ তীব্রভাবে নাড়া খায়। এ ঘটনা উভয় দেশের সম্পর্কের ওপর মারাত্মক দাগ ফেলে। প্রতিক্রিয়ায় বিএসএফের প্রধান ইউ কে বনসাল উস্কানিমূলক মন্তব্য করেন যে, সীমান্তে পূর্ণভাবে গুলি বন্ধ করা অসম্ভব।
এ কারণেই ভূ-সীমান্তবিষয়ক চুক্তি বাস্তবায়নে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক। এর পাশাপাশি ইতিমধ্যে চালু হওয়া সমন্বিত সীমান্ত-ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন চুক্তি, সংগঠিত অপরাধ ও অবৈধ মাদকদ্রব্য চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থার সুবাদে সীমান্তের পরিবেশও বৈরিতামুক্ত হবে। এতে করে সুগম হবে আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর অধীনে মানুষ ও পণ্যের চলাচলও। উভয় দেশ যে ট্রানজিট সুবিধার জন্য নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে, এটা তা বাস্তবায়নেরও পূর্বশর্ত।
আরও বড় মাপে দেখলে অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর অনেক বেশি বাজি ধরে বসেছেন। অন্যদিকে, তাঁর বিরোধী বিএনপি সুযোগ পেলেই ভারতকে মোড়লিপনার অভিযোগ করতে ছাড়ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যেও সন্দেহপ্রবণ লোকের কোনো অভাব নেই। এ রকম এক পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে অংশীদারি বাড়ানোর পদক্ষেপ চালিয়ে যাওয়ার ষোলো আনা কৃতিত্ব শুধু শেখ হাসিনারই।
বাঁধাধরা পথ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতের নিরাপত্তা চিন্তাকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশে কার্যরত ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করেছেন। তিনি তাঁর দেশে ভারতীয় বিনিয়োগ স্বাগত জানিয়েছেন। যারা দেশভাগের চশমা দিয়ে ভারতকে দেখে, সেই উগ্র গোষ্ঠীগুলোকেও মোকাবিলা করে যাচ্ছেন তিনি। ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারপ্রক্রিয়া দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও আইনের শাসনের প্রতি তাঁর নিষ্ঠার পরিমাপও করা যায়।
এই পটভূমিতে এটা বলায় অত্যুক্তি হবে না, বর্তমান সময়ই ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের সবচেয়ে সুবর্ণ সময়। কিন্তু সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। উভয় দেশের উভয় সরকারেরই মেয়াদ বাকি আছে আর দুই বছর। এবং তাদের পুনরায় ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাও অনিশ্চিত। সব বিচারেই নয়াদিল্লির ইউপিএ জোটকে এ জন্য কঠিন লড়াই চালাতে হবে। একইভাবে, বাংলাদেশের চরম বিভক্ত রাজনৈতিক সমাজে, বিএনপির চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি ভোট পাওয়ার সুবিধাজনক অবস্থা বহাল রাখতে আওয়ামী লীগকেও তার কর্মসূচি কাটছাঁট করতে হবে।
এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলোর ব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলোকে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গকে রাজি করানোয় কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। কেননা, ইতিমধ্যে ঢাকা মনে করা শুরু করেছে, ভারতের সব আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্য স্বার্থ চরিতার্থ করা। বাস্তবে যদি কিছু ফল দেখা না যায়, উভয় দেশের নেতা পর্যায়ে যতই সখ্য দেখা যাক না কেন, তা শুভ হবে না।
অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি যেহেতু এ মাসেই ঢাকা সফরে যাচ্ছেন, তাঁর উচিত হবে কেবল কথা না বলে কিছু কাজও করা। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার সুফল ঘরে তুলতে হলে অবশ্যই নয়াদিল্লির ওপর ঢাকার বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে হবে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদীত
রুদ্রনীল ঘোষ: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.