সাক্ষ্যে আবেদ খান-সাঈদী পারেরহাটে নির্যাতন ও লুণ্ঠন করেছিলেন

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জবানবন্দিকালে সাংবাদিক আবেদ খান বলেছেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী রাজাকার বাহিনী গঠন করে পিরোজপুরের পারেরহাট এলাকায় নির্যাতন চালিয়েছিলেন।


পারেরহাট বন্দর বাজারের ব্যবসায়ী নারায়ণ সাহা, বিপদ সাহা ও মদন সাহার বাড়িঘর-দোকান লুণ্ঠন করেছিলেন।
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২৬তম সাক্ষী আবেদ খান গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। জবানবন্দির একপর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলীর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, সাঈদীর সঙ্গে সাত সদস্যের একটি বাহিনী ছিল। তারা ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে বেলা পৌনে ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আবেদ খান জবানবন্দি দেন। ২০০৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ‘জামাতের গড়ফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাঈদীসহ জামায়াতের চার নেতার নাম ছিল। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ওই প্রতিবেদনকে সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করায় ওই সময়ে সমকাল-এর সম্পাদক থাকা আবেদ খান গতকাল জবানবন্দি নেন।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাঈদী কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কি না—সৈয়দ হায়দার আলীর এ প্রশ্নের জবাবে আবেদ খান বলেন, প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর তিনিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাঈদী আদালতে ১০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। পরে মামলাটি আদালত খারিজ করেন। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তি কী ছিল—কৌঁসুলির এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি স্থানীয় সংবাদদাতাদের পাঠানো, ডেস্কে সমন্বয় করা হয়েছিল।
এরপর আবেদ খান একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিছু বলার আবেদন জানালে ট্রাইব্যুনাল অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে তিনি বলেন, সাঈদী জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জামায়াতের রাজনীতির প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী প্রতিটি মুহূর্তে একটি বিশেষ দর্শন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তা জামায়াত ১৯৭১ সাল থেকে এখনো বজায় রেখেছে।
আবেদ খান বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ’৬২-র সামরিকতন্ত্রবিরোধী ও শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। যার পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকেই গোলাম আযম এবং সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে আমরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠনে সক্রিয় দেখতে পাই। কাজেই সাঈদী সাহেব যখন লুণ্ঠনে কিংবা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর অনুচর হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে নিজেকে নিয়োজিত করেন, তখন স্বাভাবিকভাবে তাঁর বাহিনীকে ধরে নেওয়া হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সংঘবদ্ধ সংগঠন হিসেবে।
এই সাক্ষী আরও বলেন, স্বাধীনতার পর মাওলানা সাঈদী ও জামায়াতের অন্য নেতারা আত্মগোপন করেন। ’৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর জামায়াত স্বরূপে আবির্ভূত হয়। গোলাম আযম ‘বিশেষ ব্যবস্থাধীনে’ বাংলাদেশে আসেন। এরপর সামরিক সরকার জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সময়ে প্রকাশ্যে জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তিনি একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ শহীদসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বলতে চাইলে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানি। আপনি সাঈদীর মামলা-সংক্রান্ত বিষয় থাকলে বলুন। না হয় আমরা আপনার বক্তব্য নেব না।’ এ পর্যায়ে আবেদ খান বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং পরবর্তী সময়ে যা দেখেছি, এটাই আমার বক্তব্য।’
জেরা: এরপর আবেদ খানকে জেরা করেন সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুর রহিম আপনার আত্মীয় কি না—মিজানুলের এ প্রশ্নের জবাবে আবেদ খান বলেন, হ্যাঁ, বিবাহসূত্রে আত্মীয়। মওদুদী কীভাবে কাদিয়ানিবিরোধী দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছিলেন—এ প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বই লিখেছিলেন। আইনজীবী মিজানুল বলেন, লেখাটি পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। এ সময় আবেদ খান বলেন, এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। সাক্ষীকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয়েও প্রশ্ন করা হয়।
বিকেল সাড়ে তিনটায় ট্রাইব্যুনাল সোমবার পর্যন্ত এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করেন। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষের অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। আবেদ খানের সঙ্গে কথা বলে সুবিধাজনক সময়ে অসমাপ্ত জেরা সমাপ্ত করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

No comments

Powered by Blogger.