স্মরণ-ফিরে এল সেই দিন by ড. বীথিকা সিংহ বল
বছর ঘুরে আবার এল সেই দিনটি। আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিশপ্ত সেই দিনটি। ২০১০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের এই দিনে এক সর্বনাশা সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে আমার স্বামী ডাক্তার উত্তমের জীবন। তছনছ করে দিয়ে গেল আমার সাজানো সংসার। অনিশ্চিত হয়ে গেল আমাদের দুই শিশুকন্যার ভবিষ্যৎ।
উত্তমের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল ১০ বছর আগে। এই ১০টি বছরের দাম্পত্য জীবন কেটেছে সুখ-সমৃদ্ধি ও হাসি-আনন্দে। মাঝেমধ্যে কৃত্রিম রাগ বা মান-অভিমান যে হয়নি, তা নয়। তবু বলব, প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসায় ভরা ওই ১০টি বছরই ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। উত্তমের স্ত্রী হিসেবে নিজেকে ভাগ্যবতীই মনে হতো, যদিও কখনো মুখে তা প্রকাশ করিনি। বিশেষ করে উত্তমের সামনে তো নয়-ই। উত্তম ছিল সবার কাছেই প্রিয়। একাধারে মাতৃভক্ত সন্তান, প্রেমময় স্বামী, স্নেহশীল পিতা, হিতৈষী বন্ধু এবং মানব-দরদি এক চিকিৎসক। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল বোধ করি পেশার প্রতি নিষ্ঠা। রোগীদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে তারপর ব্যবস্থা লিখে দিত। টাকার জন্য রোগীদের কখনো পীড়াপীড়ি করত না। গ্রামগঞ্জ থেকে আসা রোগীদের অনেকের কাছ থেকে অনেক সময় কম 'ফি' নিত। প্রকৃত দুস্থ রোগী হলে একেবারেই নিত না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোয়ার্টারে থাকতাম। ক্যাম্পাসবাসীদের জন্য উত্তমের দরজা ছিল সব সময় খোলা। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই উত্তম তাঁর গ্রামের বাড়ি যেত মাকে দেখে আসার জন্য। অনেক সময় আমিও সঙ্গে যেতাম। দুই-তিন ঘণ্টা থেকে মাকে দেখে অথবা মাকে নিয়েই আমরা চলে আসতাম। ওই অল্প সময়ের মধ্যেও বাড়িতে গ্রামের লোকদের ভিড় জমে যেত। নিজেদের ছেলে ডাক্তার। তাঁর চিকিৎসা পাওয়ার জন্য গ্রামের মানুষ উন্মুখ হয়ে পথ চেয়ে থাকত। কখন ডাক্তার আসে। উত্তম কাউকে নিরাশ করত না। একের পর এক রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে যেত। কোনো কোনো দিন ভিড় এত জমে যেত যে খাওয়ার সময়টুকুও পাওয়া যেত না। কিন্তু উত্তমের কোনো ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই। উত্তম যেন ওদের কাছে সাক্ষাৎ ভগবান। উত্তম ছিল একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, এফসিপিএস। অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও ওর কাছে রোগী আসত। উত্তমের সুনাম ও খ্যাতি দিন দিন বাড়ছিল। আমরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা এক সুন্দর জীবনের স্বপ্ন। হঠাৎ করে নিষ্ঠুর পরিণতি আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল। সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রতি শুক্রবারই উত্তম নওগাঁ যেত 'ক্লিনিক' করতে। ক্লিনিক শেষে আবার সেই রাতেই ফিরে আসত। সেদিনও ক্লিনিক শেষ করে যখন গাড়িতে বাড়ি ফিরছিল, তখন ওর সঙ্গী ছিল দুজন। ড্রাইভার এবং এক সহকর্মিণী ডাক্তার। আমাদের পারিবারিক বন্ধু। গাড়িটি ছিল ভাড়া করা। উত্তমের পছন্দের সব খাবার তৈরি করে বসে আছি। ও এলে সবাই একসঙ্গে খাব। হঠাৎ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। খবর এল_উত্তম আর নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। মাথার মধ্যে যেন শত শত বোমা বিস্ফোরিত হয়ে গেল। আমি হতভম্ব-হতচকিত। তারপর কোথা দিয়ে কী সব হয়ে গেল। বাড়িতে শুধু লোক আর লোক। একসময় মরদেহ এল। গ্রামের বাড়িতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে সবাই ফিরে এলাম। যে যার ঘরে চলে গেল। শুধু উত্তম এল না। স্ত্রী হিসেবে উত্তমের মৃত্যুটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। রাজপথের ওপর একটি ভাঙা ব্রিজ কী করে অযত্ন-অবহেলায় খোলা পড়ে থাকে? কোনো প্রতিবন্ধক দেয়াল নেই, কোনো বিপদচিহ্ন নেই! যেকোনো মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ তো কর্তব্যে ঘোর অবহেলা। এই অবহেলাই কি উত্তমের মৃত্যুর জন্য দায়ী? উত্তমের মৃত্যুর কোনো পুলিশি তদন্ত হয়নি। এমনকি পোস্টমর্টেমও করা হয়নি। কখন, কিভাবে, কোন অবস্থায় উত্তমের মৃত্যু হলো তা সঠিকভাবে জানা গেল না। হয়তো কখনোই জানা যাবে না। আমি কিন্তু উত্তমের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। ও যেন কানে কানে বলে, 'এ দুর্ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা নয়।'
ড. বীথিকা সিংহ বল
ড. বীথিকা সিংহ বল
No comments