ভাগ-বাঁটোয়ারায় সমানে সমান আ.লীগ-বিএনপি by আনোয়ার পারভেজ

কালাই উপজেলায় ২০১০-১১ অর্থবছরে কাবিখা, কাবিটা ও টিআর কর্মসূচি বাস্তবায়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকার খাদ্যশস্য ও নগদ অর্থ। ত্রাণ অধিদপ্তর থেকে বিএনপিদলীয় স্থানীয় সাংসদ গোলাম মোস্তফা ও সংরক্ষিত নারী আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ শাহিন মনোয়ারা হক এবং উপজেলা পরিষদ বরাবর এই বরাদ্দ আসে।


গোলাম মোস্তফার সুপারিশে কাবিখার পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৮ লাখ টাকা ও শাহিন মনোয়ারা হকের সুপারিশে দুটি প্রকল্পে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবার তাঁদের সুপারিশে টিআর কর্মসূচিরও ৯০টি প্রকল্প বাস্তবায়নে নগদ ৩৮ লাখ টাকা এবং ৩৫ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব অর্থ ও খাদ্যশস্যের সিংহ ভাগই লুটপাট হয়েছে। আর এ কাজে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সমান ‘দক্ষতা’ দেখিয়েছেন।
ভাগ-বাটোয়ারায় বিএনপি: সাংসদ গোলাম মোস্তফার সুপারিশে উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের টাকাহুত আস্তানা শরিফ উন্নয়নের নামে টিআর থেকে ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন প্রকল্প সভাপতি ও বিএনপির কর্মী সাইদুর রহমান। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের নথিতে ভুয়া ভাউচার দাখিল করে এ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত দেখানো হয়েছে। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনো কাজই হয়নি। সাইদুর রহমানও স্বীকার করেন, ‘বরাদ্দের অর্থ আস্তানা উন্নয়নে খরচ করা হয়নি।’ সাংসদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের।’
উপজেলার পুনট ইউনিয়নের শান্তিনগর বাজারের একটি কীটনাশকের দোকানকে ‘শান্তিনগর এমআর (মামুন-রাবেয়া) মর্ডান চাইল্ড স্কুল’ দেখিয়ে দুই দফায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার টিআরের অর্থ উত্তোলন করেছেন বিএনপির স্থানীয় কর্মী মামুনুর রশীদ। শান্তিনগর বাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কীটনাশক ঘর ভাড়া নিয়ে শিশুদের প্রাইভেট পড়াতেন মামুনুর রশিদ। এটাকে স্কুল দেখিয়ে তিনি এক লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ নিয়েছেন।’ মামুনুর রশীদ দাবি করেন, ‘অনুমোদিত স্কুল না হলে সাংসদ বরাদ্দ দিতেন না। বরাদ্দের টাকায় স্কুলে ল্যাপটপ ও বেঞ্চ কেনা হয়েছে।’ সাংসদ গোলাম মোস্তফাও দাবি করেন, ‘কিন্ডারগার্টেন স্কুল হওয়ায় ওই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের চাঁনবিল-বাখড়া জলডারি সংযোগ থেকে মহিষের ঘাট পর্যন্ত খাল পুনঃখননের নামে কাবিখার ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ নেন উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর। অর্থবরাদ্দের সুপারিশ করেন সাংসদ গোলাম মোস্তফা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, মাত্র দেড় লাখ টাকার মাটি কেটে আবদুস সবুর বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তবে আবদুস সবুর দাবি করেন, বিধিমোতাবেক যতটুকু মাটি কাটার কথা ছিল তাই কাটা হয়েছে।
গোলাম মোস্তফার সুপারিশে পাঁচগ্রাম ভোতার পুকুর পুনঃখনন, পাঁচগ্রাম-দুর্গাপুর রাস্তা খনন, শমশিরা-কয়তাহার খাড়ি সংস্কার ও বেউড়গ্রাম রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও এসব প্রকল্পে নামমাত্র মাটি কেটে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। সাংসদেরই সুপারিশে উপজেলার করমকা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি নামে একটি ভুয়া সংগঠনের অনুকূলে ৪০ হাজার টাকা, কাটাহার নতুন কুঁড়ি সমাজকল্যাণ সংঘের অনুকূলে ২৮ হাজার টাকা, কালাই মহিলা জনকল্যাণ সমিতির নামে ২৮ হাজার টাকা ও স্থানীয় দুই এনজিও গরিব উন্নয়ন সমাজসেবা সংস্থা ও সোনালী সকালের নামে এক লাখ ১০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ভুয়া ভাউচার দিয়ে বরাদ্দের এসব অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। একইভাবে পশ্চিম কুজইল আস্তানা শরিফ উন্নয়নে ২৮ হাজার টাকা, শিকটা ও দেওগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়নে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো কাজ করা হয়নি।
গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, ‘ভুয়া কোনো সংগঠনের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। নিয়ম মেনেই এসব সংগঠনে বরাদ্দের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।’
এবার আওয়ামী লীগ: আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ শাহিন মনোয়ারা হকের সুপারিশে কাবিখা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ দেওয়া নগদ ১০ লাখ টাকা, টিআর কর্মসূচির আট লাখ টাকা ও খাদ্যশস্য আত্মসাৎ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের হাজিপুর হামচা পুকুর ও চিল্লা পুকুর পুনঃখনন প্রকল্পে কাবিখার ১০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রায় পুরোটায় আত্মসাৎ করেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। একই সাংসদের সুপারিশে ওই নেতা মোলামগাড়িহাট আদর্শ কলেজ নামে একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে টিআরের এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ নিয়েছেন। এখানেও কোনো কাজ হয়নি। তবে সাইফুল ইসলামের দাবি, ‘নিয়ম মেনেই কাবিখা প্রকল্পে মাটি কাটা হয়েছে। বন্ধ থাকা মোলামগাড়িহাট আদর্শ কলেজটি নতুন করে চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
শাহিন মনোয়ারা হকের সুপারিশে কাদিরপুর বাখড়া পাবস সমিতি নামে একটি কাগুজে সংগঠনের নামে ৯৩ হাজার টাকা বরাদ্দ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহসিন আলী। সোশ্যাল অর্গানাইজেশন অব মাত্রাই ও শান্তিনগর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়নের নামে প্রায় দুই লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতা।
জানতে চাইলে সাংসদ শাহিন মনোয়ারা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার নেতা-কর্মীরা প্রকল্পের যে তালিকা নিয়ে আসেন; দল ও নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের স্বার্থে সেই তালিকায় সুপারিশ করে পাঠানো হয়। সংগঠন সঠিক কি না, সেটা একজন নারী সাংসদ হিসেবে নওগাঁ (নিজ জেলা) থেকে শনাক্ত করা কঠিন। কোনো ভুয়া বা কাগুজে সংগঠনের নামে বরাদ্দ নেওয়া হলে সেটার জন্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই দায়ী। আর বরাদ্দের অর্থ লুটপাট হয়ে থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের।’ তিনি আরও জানান, ‘গত অর্থবছরে দলের উপজেলা সভাপতি এসে বিভিন্ন প্রকল্পে ৩৫ টন চালের বরাদ্দ নিয়ে যান। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এক টনেরও কাজ হয়নি।’

No comments

Powered by Blogger.