ভস্ম থেকে জেগে উঠুক চেতনার আগুনপাখি by হাসান মোরশেদ

পৃথিবীর দেশে দেশে সব সময়, সব মানুষের শুভবোধের পক্ষে, অসুন্দর ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের গল্পটা মূলত একই। এই প্রতিরোধ কখনো ফুরায় না, শুভবোধের পক্ষে সংগ্রাম তাই একটি নিয়ত চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই স্মৃতি সংরক্ষণ করতে হয়, কোনো কোনো সময় স্মৃতিকে পাহারা দিতে হয়।


কেননা ঘাতকরা চায় প্রতিরোধের স্মৃতি মুছে দিতে, যে সমূহ স্মৃতি থেকে জন্ম নিতে পারে নতুন প্রতিরোধের চেতনা। এই শহর, এই মায়াবী মনোটোনাস শহর দীর্ঘ ২২টি বছর বিস্মৃত থেকেছে একটি শোকার্ত দিন, তার তিনটি সন্তানের বীভৎস খুন, যাঁরা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বীজাণুবাহী ঘাতক-দালালদের প্রতিরোধে ব্যারিকেড হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মিথিক্যাল সাহসে ভর করে। এই শহর, এই বিস্মৃতির বিমর্ষ শহর তার সন্তানের ঘাতকদের তুমুল আস্ফালন দেখে গেছে কেবল, যাদের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ছিল তাদের আপস, নিবীর্যতা, অসহায়ত্বের সাক্ষী হয়েছে কেবল। যেমন এই রাষ্ট্র ভুলে থেকেছিল তার ৩০ লাখ সন্তানের নাম, মুছে ফেলতে চেয়েছিল মানচিত্রে লেগে থাকা গণহত্যার দাগ। কিন্তু মানুষ, শুভবোধের সপক্ষের মানুষ সেই আশ্চর্য আগুনপাখি সহস্র বিস্মৃতির ব্যারিকেড ভেঙে যে বেরিয়ে আসে, ছাইভস্ম থেকে জন্ম নেয় নতুন করে বারবার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তাই রুদ্ধ করা যায়নি কোনো ষড়যন্ত্রেই, থামানো যায়নি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। এই স্বপ্নযাত্রায় প্রতিটি প্রতিরোধ ও আত্মদানের স্মৃতিই একেকটি স্মারক। প্রতিটি স্মারককে স্পষ্ট করে তুলতে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। এই স্মারকগুলো বাতিঘর হয়ে পথ দেখাবে, চিনিয়ে দেবে প্রগতির পথে কে ভাই আর কে দুশমন। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক ঘাতকদের প্রতিরোধ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম দিন। না, রাজধানী ঢাকায় নয়, ঘাতক জামায়াত-শিবিরকে সর্বাত্মক প্রতিরোধের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল শহর সিলেটে ১৯৮৮-র শুরুতেই। একদিকে সামরিক স্টিমরোলার, অপরদিকে ঘাতক-দালালদের নৃশংসতায় রুখে দাঁড়িয়েছিল শহর সিলেটের মানুষ। প্রগতিশীল ছাত্রদের গড়ে তোলা প্রতিরোধ আন্দোলন যখন সামাজিক আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে, তখনই সামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় ঘাতক জামায়াত-শিবির চরম আঘাত হানে। এক দিনে শহীদ হন তিন প্রতিরোধযোদ্ধা_মুনীর-তপন-জুয়েল।
তারপর দীর্ঘ ২২টি বছর তাঁরা বিস্মৃত, দীর্ঘ কালঘুম আমাদের। গত বছর হঠাৎ করেই শহর সিলেটের কিছু তরুণ, যাঁরা মুনীর-তপন-জুয়েলের আত্মদানের সময় নেহাত শিশু ছিলেন, তাঁরা পণ করেন_বিস্মৃতির ভস্ম ঠেলে জাগাবেনই চেতনার আগুনপাখি। মুনীর-তপন-জুয়েলের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁরাই যোগাযোগ করেন, প্রগতিশীল বাংলা ব্লগগুলো সহযোগী হয়, ফেইসবুকে ছড়ানো হয় বার্তা এবং দীর্ঘ ২২ বছর পর শহর সিলেট আবার বেঁচে ওঠে। আলোর মিছিলে সারথী হয় শত মানুষ। স্মৃতি, সম্মান ও শোকে উচ্চারিত হয় শহীদদের নাম, ঘাতকদের বিচারের দাবি পুনরোচ্চারিত হয় প্রকাশ্যে। ২৪ সেপ্টেম্বরের আত্মদান কেবল সিলেটের নয়; এই প্রতিরোধ যুদ্ধ, তিন শহীদের আত্মদান একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্য, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশের জন্য। তাই শহীদ মুনীর-তপন-জুয়েল যেন স্মরিত হন সমগ্র দেশে। দেশের আনাচে-কানাচের যেকোনো অঞ্চলের শুভবোধসম্পন্ন মানুষ যেন শোকার্ত হন, যেন প্রতিরোধের স্পৃহায় ঐক্যবদ্ধ হন। সেপ্টেম্বর ২৪ তাই ভোলা যাবে না। বিস্মৃতির ছাইভস্মে আর ঢেকে রাখা যাবে না শহীদ মুনীর, তপন, জুয়েলের স্মৃতি। জীবিত জুয়েল, মুনীর ও তপন একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের প্রতি কারো সমর্থন না থাকতে পারে, কিন্তু শহীদ মুনীর, তপন ও জুয়েল দলীয় পরিচয়ের সীমানা পেরিয়ে একটা পরিচয়েই অমর হয়ে গেছেন_মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের সাহসী সৈনিক তাঁরা। রাজনীতির নামে, ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশে এই দিনকে ভুলে থাকা মানে ঘাতক-দালালদের জন্য আরেকটু পথ ছেড়ে দেওয়া। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের প্রতি যদি কারো সমর্থন থাকে, শুভবোধের প্রতি থাকে পক্ষপাত, তবে সেপ্টেম্বর ২৪-এ শহীদদের স্মৃতিতে একটু আনত হোন, বুকের ভেতর লাল টুকটুকে স্বপ্নটাকে আবার হাত বুলিয়ে প্রত্যয় নিশ্চিত করুন_'নো পাসারানো'_মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নূ্যনতম কোনো আপস নয়। এ বছরও ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আলোর মিছিলে মিলিত হব আমরা সিলেটবাসী। একই সময়ে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জেও এই কর্মসূচি পালিত হবে। দেশের আর সব অঞ্চলে কি ২৪ সেপ্টেম্বর 'মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দিবস' পালন সম্ভব নয়? মানুষের শুভবোধের জয় হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.