লাল-সবুজের পাশে-শান্তির কবুতর বনাম কুমিরের মুরগি ভক্ষণ by আনিসুল হক

মারিয়াম বাংলায় বললেন, ‘ঘুঘু ঘুঘু’। আমাদের একজন বললেন, ‘ঘুঘু না কবুতর?’ মারিয়াম বললেন, ‘কবুতর, কবুতর।’
মারিয়াম কিছু কিছু বাংলা শব্দ জানেন। তিনি আইভরি কোস্টের রাজনৈতিক রাজধানী ইয়ামোসুকরোর ব্যাসিলিকা গির্জার গাইড।


২৬ জানুয়ারি আমরা বুয়াকে থেকে প্রথমে আসি এই রাজধানী শহরে। বিশাল রাস্তা। রাজধানী হলেও পথঘাট জনবিরল। বহু দূর থেকে দেখা যায় ব্যাসিলিকা গির্জা। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা।
অ্যাঞ্জেলা মারিয়াম বাংলা শব্দ শিখেছেন বেশ কিছু। তিনি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর শিবিরের পাশের জনপদে থাকতেন।
ব্যাসিলিকা গির্জার পুরো নাম ব্যাসিলিকা অব আওয়ার লেডি অব পিস অব ইয়ামোসুকরো। এর প্রতীক dove-এর বাংলা কোনো বাঙালি তাঁকে শিখিয়েছেন ঘুঘু, কেউ শিখিয়েছেন কবুতর। অ্যাঞ্জেলা মারিয়াম তাই একবার বলেন ‘ঘুঘু’, একবার ‘কবুতর’।
কৃষ্ণাঙ্গ মারিয়াম খ্রিষ্টান। কিন্তু তাঁর দাদি ছিলেন মুসলমান। তাই তাঁর নামের এক অংশ মুসলিম, আরেক অংশ খ্রিষ্টান। এ সবই তিনি গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন। আমরা তাঁর পেছন পেছন গির্জার বিভিন্ন অংশে হাঁটছি।
গির্জাটা সত্যি সত্যি অকল্পনীয় বিশাল। এর উচ্চতা ৫১৮ ফুট। ভেতরে বসতে পারে সাত হাজার মানুষ। ভেতর-বাইরে মিলে এর ধারণক্ষমতা ১৮ হাজার জন। ভেতরে ১২টা স্তম্ভ আছে, যেগুলোর ভেতরে আছে হয় সিঁড়ি, নয়তো লিফট। মেজর মাসুদ এর আগেও এসেছেন এই গির্জায়। এই লিফটে ওঠার পরে একবার এক ঘণ্টা আটকে ছিলেন, লিফট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর ভেতরের বাতি নিভে গিয়েছিল। তাঁর মুখে সে-কথা শোনার পরে লিফটে উঠতে সত্যিই ভয় পাচ্ছিলাম। ১০ জন ধারণক্ষমতার লিফট, মারিয়াম নিজে লিফটে উঠে ডাকেন, আরও আসতে পারো পাঁচজন। মারিয়াম নিজেকে পাঁচজনের সমান ওজস্বী বলে ভাবেন, আমার অবশ্য এই হিসাবটাকে একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হলো।
১৯৯০ সালে এই গির্জার নির্মাণকাজ শেষ হয়। খরচ পড়েছিল ৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
একই শহরে আছে একটা খুবই সুদৃশ্য পার্লামেন্ট ভবন, Houphouet Boigny ফাউন্ডেশন অব পিস। আমরা এসব ঘুরে ঘুরে দেখি আর ভাবি, এদের গির্জার নামের সঙ্গে শান্তি, এদের পার্লামেন্ট ভবনের নাম শান্তি, কিন্তু দেশটায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাখতে হয়েছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে। ৩০ কোটি ডলারে বানানো গির্জার কত কাছে দারিদ্র্য জর্জর বস্তি। বেশ বোঝা যাচ্ছে, এই দেশে বৈষম্য প্রবল। সম্পদ গুটি কয়েক মানুষের হাতে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ বিস্তৃত এলাকাজুড়ে আর বেশির ভাগ মানুষ থাকে অরণ্যে, পর্ণকুটিরে। অ্যাঞ্জেলা মারিয়ম নামের মধ্যে খ্রিষ্টান-মুসলমান মিলনের কথা আছে। কিন্তু এই দেশে দ্বন্দ্বের একটা উপাদান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বও। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওয়াতারা মুসলিম। আর ক্ষমতা হারানো বিচারাধীন বাগবো খ্রিষ্টান। দ্বন্দ্ব উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের, উত্তরে বসবাস মুসলিমদের গরিষ্ঠতা, দক্ষিণে সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিষ্টানরা।
আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল দেশটি, এখনো ফরাসিরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে এখানকার রাজনীতি, অর্থনীতির গতি-প্রতিকৃতি।
প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনের খালে সত্যি সত্যি কুমির আছে কি না, দেখতে যেতেই হলো। যদিও এখন রাষ্ট্রপতি থাকেন আবিদজানে, কিন্তু প্রাসাদ আর তার চারপাশের খালে কুমিরের দল তো রয়েই গেছে। আমরা চললাম কুমির দেখতে। আমাদের দলটি বেশ বড়সড়। আমরা বাংলাদেশ থেকে আসা ১০ সদস্যের শান্তি মিশন পরিদর্শক দলটি তো আছিই, সঙ্গে আছেন এই শহরের বাংলাদেশি পুলিশ দলের কর্মকর্তারা, আছেন আইভরি কোস্টে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সেনা কর্তাদেরও কেউ কেউ। আমাদের খালপারে আসতে দেখে কুমিরের দল ছুটে এল। খাবারের লোভেই। একজন স্থানীয় মানুষ জুটে গেল, যে কিনা লেকের জলে মুরগি নিক্ষেপ করবে। কুমিরেরা হাঁ করে মুরগি খেয়ে ফেলছে, এই দৃশ্য দেখতে হলো মজার দৃশ্য হিসেবে। ব্যাপারটা বেশ নৃশংস। কিন্তু এই দেশ, গৃহযুদ্ধের ১০টা বছরে, এর চেয়েও নৃশংস দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে। শুধু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, মানুষ হত্যা করেছে মানুষকে—রাস্তায় একদল মানুষ আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে আহত জীবন্ত মানুষের শরীরে, এ রকম ভিডিও ক্লিপিং দেখতে গিয়ে বিবমিষার শিকার হয়েছি।
এর আগে বাংলাদেশের পুলিশের একটা শিবিরে আমাদের শোনানো হলো তাদের কার্যক্রমের বিবরণ। ১৮০ জন পুলিশসদস্য আছেন এই শিবিরে। এর নাম ব্যানএফপিইউ ২। এই শিবিরের ভেতর ঢুকে মনে হলো যেন বাংলাদেশের ভেতরেই আছি। এঁরা এঁদের প্রাঙ্গণে দেশি শাকসবজি, ফলফুলের গাছ লাগিয়েছেন।
এই পুলিশ দলটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের গাড়ির বহর চলল দালোয়া শহরের দিকে। শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিতে হচ্ছে। পথের দুই ধারে বনবনানী, জঙ্গল, গাছপালা, কফির গাছ, কোকোয়ার গাছ। কিন্তু কেউ এসবের কোনো যত্নআত্তি করে বলে মনে হলো না। এই পথে একটা-দুটো মানববসতি দেখা যাচ্ছে অন্তত, দু-একটা জায়গা দেখতে অনেকটা আমাদের উপজেলা শহরের মতো। পথের ধারে একটা স্কুল চোখে পড়ল পড়ন্ত বিকেলের আলোয়, সেখানে কমলা রঙের জার্সি পরা শ খানেক বালক ফুটবল প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এরা প্রত্যেকে খালি-পা, মাঠেও ঘাস নেই, কাঁকরভরা মাটি। অথচ এদের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে দ্রগবা, এরাই ভবিষ্যতে খেলবে বিশ্বকাপ।
আমাদের গাড়ি দালোয়া শহরে প্রবেশ করল।
দালোয়া হলো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর পশ্চিম সেক্টরের হেড কোয়ার্টার। সেক্টর কমান্ডার হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুল হক।
দালোয়ায় বাংলাদেশ থেকে আসা শান্তিরক্ষীর সংখ্যা সহস্রাধিক। দালোয়ায় আমাদের জন্য অনেক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতাই অপেক্ষা করছে।

No comments

Powered by Blogger.