রবার্ট ফিস্ক-জেরুজালেমে প্রার্থনা, বিদ্রূপ এবং ক্লান্তিকর প্রতিবাদ

লাল টি-শার্ট পরা একজনের সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম। মধ্যবয়সী এই ব্যক্তির বাঁ বাহুর নিচে ছিল একটি জায়নামাজ। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বারাক ওবামার বক্তৃতা সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী। দাঁত বের করে তিনি হাসলেন। মনে হলো, আমি কী ভাবছি তিনি তা জানেন। উল্টো তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি কী আশা করছিলেন?' তবে সঠিক অনুমানই করা হচ্ছিল। হারেজ চলতি সপ্তাহেই প্রেসিডেন্টকে একটি বক্তৃতা লিখে পাঠিয়েছেন।


আর তখনই ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, ওবামা সেই বক্তৃতায় তাঁর দুই হাত ব্যবহার করে স্বাক্ষর করবেন। অন্যদিকে এটাও সত্য যে ওবামাও চাইছেন ইসরায়েলের ন্যাসেটে শিগগিরই নির্বাচন হোক। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন জেরুজালেমের রাস্তায় মানুষের অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের আন্দোলনে ক্লান্ত বলে মনে হয়েছে। এদিকে জেরুজালেমে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে বলে ইসরায়েলের পত্রপত্রিকা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু সকালবেলা দলবদ্ধ মানুষ আল-আকসার দিকে গেল। তারা তাদের জায়নামাজগুলো দামাস্কাস গেটের সামনে, মসজিদের পেছনে কিংবা রাজপথে বিছিয়ে দিল নামাজ পড়ার জন্য। তাদের মধ্যে ওবামার বক্তৃতা সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ দেখা গেল না। হয়তো বা তাদের ক্রোধ মারাত্মক আকার ধারণ করবে, যখন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এ ক্ষেত্রে আমার সন্দেহটাও থেকেই যায়।
তবে বিষয়টি আবু গারাইব নির্যাতনচিত্রের পরিণতির মতোও মনে হয় কিছুটা। মনে আছে, যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু ছবি প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, এসব ছবি প্রকাশিত হলে ইরাকে হিংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ওই সময় আমি বাগদাদে ছিলাম। সেদিন ইরাকের কাউকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি। কিন্তু ইরাকিরা তার আগেই সেখানকার ঘটনাগুলো সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। জেরুজালেমে সম্প্রতি আমি যা দেখেছি, তাও সে রকমই মনে হয়। ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘতম সময়, অর্থাৎ ৪৪ বছর ধরে দেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে সাম্রাজ্যবাদী ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। সকালের নামাজের সময়ও ইসরায়েলের অপশাসনকে ফিলিস্তিনিরা হজম করে নিচ্ছে। আল-আকসা মসজিদের কাছে গিয়ে নামাজ আদায় করার জন্য ৫০ বছরের নিচের কাউকে সুযোগ দেওয়া হয় না। বাইরে নামাজিরা জায়নামাজ বিছিয়ে নেন। এমনকি কখনো তাঁরা ট্রাফিক আইল্যান্ডেও নামাজের বিছানা পেতে নিতে বাধ্য হন। ইসরায়েলি বর্ডার গার্ড এবং সেনারা বিষয়টি রুটিন ওয়ার্ক বলেই মনে করে। সেখানে ইসরায়েলি পুলিশের ঘোড়ার পায়ের শব্দও শোনা যায়। আমি যখন সেখানে যাই, ইসরায়েলি পুলিশ আমার পরিচয়পত্র দেখতে চায়। জানতে চায় আমার কাছে সাংবাদিক হিসেবে কোনো পরিচয়পত্র আছে কি না। পরিচয়পত্র দেখার পর বাধা তুলে নিল, আমাকে যেতে দিল। টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো ইসরায়েলি সেনাদের অস্ত্র উঁচিয়ে থাকার দৃশ্যগুলো খুবই সন্তর্পণে ধারণ করল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা দেখা যায় পশ্চিম তীরে। কিন্তু সেসব দৃশ্য টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো ধারণ করতে পারে না কিংবা ধারণ করে না। বিশেষ করে ইসরায়েলের বন্দুক যখন ফিলিস্তিনিদের দিকে তাক করা থাকে, সেই চিত্র কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না। অন্যদিকে নাবলুস থেকে ৩০ মাইল দূরে মসজিদের দেয়ালে মুহাম্মদ (সা.)কে কটাক্ষ করে চিকামারা দেখলাম। তখন ভাবতে মোটেও অসুবিধা হয়নি, আরব-ইসরায়েল সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এত সহজ কোনো বিষয় নয়। ফিলিস্তিনিরা ওই কটাক্ষের অংশবিশেষ দাগ দিয়ে রেখেছে। একইভাবে হেবরনেও মসজিদের গায়ে দেখা যায় এমন কিছু, যা হিব্রু ভাষায় লেখা। আবার ইসরায়েলের বিভিন্ন দেয়ালে রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো এমনভাবে লেখা আছে, যা যেকোনো ফিলিস্তিনিকে উত্তেজিত করতে পারে। আমরা পশ্চিমের মানুষেরা কিন্তু এসব ব্যাপারে খুব একটা শব্দ করি না। হতে পারে আমরা তাকে নিরাপত্তার বিষয় বলে মনে করি। আল-আকসা মসজিদে সকালের নামাজ শেষ হলো। পুলিশ তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। দোকানগুলোও একে একে খুলতে থাকল। এমন সময় দেখলাম, এক নারী ধীরপায়ে এগিয়ে আসছেন। তিনি শিশুদের কাপড় এবং প্লাস্টিকের জুতার দোকান সাজানোর প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু একজন সেনা এসে বলে, 'আরো তিন ফুট পেছনে যাও। রাস্তায় দোকান খোলা যাবে না।' বৃদ্ধা দোকানি তখন চিৎকার করতে থাকেন। স্পষ্টতই তিনি আরবি ভাষায় বলছিলেন_সব শেষ হয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল ওই নারী বলছেন, ফিলিস্তিনিদের সবই শেষ হয়ে গেছে। সেনাটি প্রতিক্রিয়ায় হাসল। সেও বলল, হ্যাঁ, নামাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তারপর অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ওই নারীর মালপত্রের বাঙ্গুলো টানতে থাকে এবং টেনেহিঁচড়ে সেগুলো উল্টে ফেলতে থাকে। ওই দৃশ্য যখন দেখা যাচ্ছিল, তখন পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন এক পর্যটক। তিনি জার্মান ভাষায় কথা বলছিলেন। তিনিও দঁাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেনাটির কর্মকাণ্ড দেখছিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই চোখজোড়া সরে যায়। কিন্তু ওই নারীর ওপর নির্যাতন চলতেই থাকে। সেনাটি ওই নারীর বাঙ্টিতে লাথি মারছিল। নারীটিও চিৎকার করছিলেন। কিন্তু উভয়ের দৃষ্টি ছিল সামনের দিকে প্রসারিত। দেখে মনে হচ্ছিল, উভয়েই ভাবছেন জেরুজালেমে এই দৃশ্য স্বাভাবিক। পর্যটকরা হয়তো ভাবতে থাকেন, এখানকার রীতিই হচ্ছে এমন। আর সেই ভাবনা নিয়েই তিনিওই নারীকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যান নিজের গন্তব্যের দিকে।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক। দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে ভাষান্তর এম হোসেইন সরকার

No comments

Powered by Blogger.