চরাচর-বিপ্লবী এক নারীর কথা by বনরূপা

প্রীতিলতা একজন বিপ্লবী। উপমহাদেশের মুক্তির আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তিনি চট্টগ্রামের বর্তমান মাস্টার লাইনের ব্রিজের নিচে। তাঁর আত্মাহুতির পর লাশ পাওয়া গিয়েছিল ব্রিজের নিচে, তা স্থানীয়ভাবে প্রচলিত। সবকিছুর ঊধর্ে্ব সত্য হলো, তিনি স্বাধীনতার জন্য আপস না করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এটাই সত্য।


একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আত্মদানের ইতিহাস রচনা করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন প্রীতিলতা। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ইতিহাসে অমর হন। তাঁকে আমাদের স্মরণ করতে হবে ইতিহাসের বড় বড় অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে কিংবা বাঁকে বাঁকে। উপমহাদেশের একটি ছোট এলাকা চট্টগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলের ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়ই। ১৯৩২ সালে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই বাঙালি নারী। পরাক্রমশালী ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আত্মদান করে প্রমাণ করে দিলেন, মেয়েরাও পারে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে। ২১ বছর বয়সী পুরুষবেশের সেই দলনেতাই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি আত্মাহুতি দিয়েছেন তবুও বিপক্ষ শক্তির কাছে মাথানত করেননি। বাঙালির ইতিহাসে তিনি এ জন্যই অমর। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। পরিবারের সদস্যরা সবাই তাঁকে ডাকতেন 'রানী' বলে। ১৯২৭ সালে চট্টগ্রামের 'খাস্তগীর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকায়, ইডেন কলেজে। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহিলাদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন। পরে কলকাতা গিয়ে বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে এসে নন্দনকানন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ১৯৩২ সালের মে মাসে আসে পরিবারের আদরের সন্তান। তাঁর জীবনে স্মরণীয় দিন। জীর্ণ এক ঘরের কোনায় আধো আলোতে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছেন মাস্টারদা সূর্য সেন। সেটাই প্রথম দেখা মাস্টারদার সঙ্গে। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে দেখে উপলব্ধি করলেন, মেয়েরাও পারে দেশের জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে। সূর্য সেন সিদ্ধান্ত নেন ইউরোপীয় ক্লাবের আক্রমণে নেতৃত্ব দেবেন প্রীতিলতা। শুরু হয়ে গেল দলের প্রস্তুতি। সাতজনের দলের দলনেতা প্রীতিলতা ছাড়াও ছিলেন বিপ্লবী কালীকিংকর, শান্তি, সুশীল, মহেন্দ্র, বীরেশ্বর, প্রফুল্ল ও পান্না। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাব থেকে বিপ্লবীদের সংকেত পাওয়ার পর প্রীতিলতার নেতৃত্বে সাতজন তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইংরেজদের ওপর। সফল হলো সেদিনের বিপ্লবীদের অভিযান। দলের সব সদস্য ফিরে এলেন। ফিরে এলেন না শুধু দলনেতা প্রীতিলতা। ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ার অপমান ঠেকাতে পটাশিয়াম সায়ানাইট খেয়ে আত্মদান করলেন তিনি। পরের দিন পুলিশ যখন পুরুষের লাশ ভেবে মাথার পাগড়ি খুলে দেখলেন লম্বা চুলের একজন নারী, তখন শুধু পুলিশই নয়, গোটা ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ল। প্রীতিলতার আত্মদানের কথা শুনে আলোড়িত হলো গোটা ভারতবাসী। আমরা অনেকেই জানি না, ভারতবর্ষের প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতার আত্মদানের কথা, দেশপ্রেমের কথা, বিপ্লবী এক নারীর কথা। প্রীতিলতা সম্পর্কে জানতে হলে ব্যাপকভাবে গবেষণা ও অনুসন্ধান প্রয়োজন। তাঁর বীরত্বগাথা ইতিহাস প্রজন্মের জানা প্রয়োজন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বার্থে, বাঙালির ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস জানতে। প্রীতিলতা যেসব স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন সেখানকার শিক্ষার্থীরাও জানে না প্রীতিলতার বীরত্বের কথা। প্রীতিলতার নামে আজও কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়নি। ইতিহাসের বীরকন্যা প্রীতিলতাকে আমাদের প্রয়োজনেই স্মরণ রাখতে হবে।
বনরূপা

No comments

Powered by Blogger.