নৌযান শ্রমিক ধর্মঘট নিরসনের উদ্যোগ নেই তিন দিনেও- মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষই অনড় অবস্থানে, চালানো হচ্ছে দু'টি স্টিমার

তিনদিন পেরিয়ে গেলেও নৌযান ধর্মঘট নিরসনের কোন উদ্যোগ নেই। মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই অনড় অবস্থানে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তাদের দাবি মেনে নেয়া না হলে কোনক্রমেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে না।
অপরদিকে মালিক পক্ষ বলছে ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেই কেবল শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা সম্ভব। বৃহস্পতিবার মালিক পক্ষ শ্রম পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করে কতটুকু বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো সম্ভব তা জানিয়ে দিয়েছে। এদিকে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা তাদের দাবির সমর্থনে বিৰোভ মিছিল ও সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে টানা তিনদিনে অব্যাহত নৌযান ধর্মঘটের কারণে নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে যাত্রী সাধারণ। পণ্য ওঠানামা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর প্রায় অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরা কাজে যোগ না দেয়ায় গত তিনদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফলে বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ রম্নটে পণ্য পরিবহনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ধর্মঘটের কারণে সদরঘাট থেকে কোন লঞ্চ ছেড়ে না যাওয়ার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়ছে যাত্রী সাধারণ ও ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে দৰিণাঞ্চলে যাত্রীর ও পণ্য পরিবহনে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় চরম বিপাকের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে তারা। অনেক ব্যবসায়ী তাদের পণ্য সদরঘাটে স্তূপ করে রেখেছেন। গত তিনদিন ধরে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে অনেকেই অপেৰার প্রহর গুনছে। সরকারের পৰ থেকে স্টিমারের ব্যবস্থা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একবারে অপ্রতুল। ফলে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে প্রতিদিন দুটি স্টিমার দক্ষিণাঞ্চলে দুটি রুটে যাত্রীবহন অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে সরকারের পৰ থেকেও আলোচনার কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টার দিকে শ্রম পরিচালক শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে মালিক পৰের সঙ্গে আলোচনায় বসে। আলোচনায় শ্রমিকদের দাবির ব্যাপারে মালিক পক্ষের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। জানা গেছে এ আলোচনায় মালিক সংগঠনের পৰে শ্রমিকদের দাবি কতটুকু মেনে নেয়া সম্ভব সে সম্পর্কে শ্রম পরিচালককে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার চেয়ারম্যান মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের পৰ থেকে যা বলার শ্রম পরিচালককে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে তিনি উলেস্নখ করেন শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার না করলে শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনায় বসা সম্ভব নয়। এদিকে যোগাযোগ করা হলে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের দাবির ব্যাপারে কোন পৰ থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা বসার প্রস্তাব দেয়া হয়নি। সংগঠনের সহসভাপতি শাহ আলম বলেন, শ্রমিকদের দাবির ব্যাপারে এখন সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব দেয়া হয়নি। শ্রম পরিচালকের সঙ্গে মালিকদের আলোচনার বিষয়টি উলেস্নখ করে বলেন, সেখানে কি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে শ্রমিকদের এখনও অবহিত করা হয়নি। তিনি জানান, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়া না হলে ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
অব্যাহত নৌযান ধর্মঘটের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নৌপরিবহন সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটি। বৃহস্পতিবার এক বার্তায় কমিটির সভাপতি ও সংসদের হুইপ নূর আলম চৌধুরী বলেন, অব্যাহত ধর্মঘটের কারণে যাত্রী সাধারণ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সারাদেশে হাজার হাজার নৌযাত্রী চরম বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। তিনি জনদুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে শ্রমিকদের দাবি দাওয়া আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
নৌযান শ্রমিক সংগঠনগুলো একই দাবি নিয়ে বিগত তিন বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। প্রতিবারই শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু বারবার চুক্তি করা হলেও শ্রমিকদের এ দাবি এখন পর্যন্ত পূরণ করা হয়নি। জানা গেছে তাদের দাবি পূরণের লক্ষ্যে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সে সময় শ্রমিকদের স্থায়ী মুজুরী কাঠামো নির্ধারণের আশ্বাসের পেক্ষিতে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়। সমঝোতা অনুযায়ী ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রমিকদের অন্তবর্তীকালীন আর্থিক সুবিধা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। একই সঙ্গে ২০০৯ সালের জানুযায়ি থেকে স্থায়ী মজুরী কাঠামো কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয়। এজন্য শ্রম মন্ত্রনালয়ের সে সময়ের সচিব ড. মাহফুজুল হককে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির ৩ মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলে তা আজও বাসত্মবায়ন করা হয়নি। প্রথম দফায় করা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় শ্রমিকরা ২০০৯ সালে নভেম্বর মাসে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পুনরায় নৌযান ধর্মঘটের ডাক দেয়। তখন মালিক, শ্রমিক ও সরকারের ত্রিপৰীয় সমঝোতার ভিত্তিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। দ্বিতীয় দফা ধর্মঘটের প্রেক্ষাপটে গত বছর ৯ নবেম্বর যে ত্রিপৰীয় চুক্তি করা হয়, তাতে বলা হয় আগামী ২ মাসের মধ্যে শ্রমিকদেন নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করে গ্রেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। এজন্য ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ চুক্তিও বাস্তবায়ন না করায় শ্রমিকরা পুনরায় এই ধর্মঘটের ডাক দেয়। স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানায়, নৌযান শ্রমিক ও মালিকপৰের অনড় অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জলপথে পণ্য পরিবহনে অচল অবস্থা অব্যাহত আছে। বৃহস্পতিবার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দেয়ায় পণ্য পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে বহির্নোঙ্গরে গম চিনি, সার, সিমেন্ট, কিংকার ও লবণ বোঝাই ১০টি মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস বন্ধ ছিল। ফলে বহির্নোঙ্গ থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ র‍ুটে পণ্য পরিবহনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ধর্মঘটের সমর্থনে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নৌযান শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ ও বিৰোভ মিছিল করেছে। সমাবেশে ঘোষণা দেয়া হয় ২২ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যনত্ম আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। নিজস্ব সংবাদদাতা কেরানীগঞ্জ থেকে জানান, লঞ্চ ধর্মঘট অব্যাহত থাকায় তৃতীয় দিনেও সদরঘাটের যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ তাদের দু'টি স্টিমার দিয়ে সীমিত পরিসরে যাত্রী পরিবহন অব্যাহত রেখেছে। বুধবার বরিশাল ও খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া দুটি স্টিমার এমভি অস্ট্রিচ ও পিএস লেপচা বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় যাত্রী নিয়ে বাদামতলী ঘাটে এসে পৌঁছায় এবং সন্ধ্যা ৬টায় আবার একই রুটে ছেড়ে যায়। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় স্টিমার দুটিতে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.