আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

 বাঙালীর দাবি ছিল সামান্য। একইসঙ্গে ন্যায্য। কিন্তু পাকিস্তান সরকার কখনই তা আমলে নেয়নি। বরং বৈষম্য আর শোষণ নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছিল।
বিস্ময়কর যে, পশ্চিম পাকিস্তানের মিডিয়া পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষের দাবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। বিবেক বিসর্জন দিয়েছিল সংবাদপত্রগুলো। ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল একাধিক পত্রিকা। ‘প্রাদেশিকতা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন লিখেছিলÑ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করারা জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা যে আন্দোলন করছে তা আসলে রাষ্ট্রদোহিতা। ভাষা প্রসঙ্গে যুবকদের কাছে যার একটি আবেগময় আবেদন আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ...যারা কায়েদে আজমের জীবদ্দশায় কোনদিন মাথা তোলার সাহস করেনি তাদের জাতির পিতার উপদেশ অগ্রাহ্য করতে প্ররোচিত করা হচ্ছে। কল্পনাপ্রসূত এমন বক্তব্য উপস্থাপন করে পত্রিকাটি আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় সরকারকে। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়Ñ যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রাদেশিকতার ওকালতি করে তাদের রাষ্ট্রের শত্রু ঘোষণা করা এবং কোন প্রকার প্রশ্রয় না দেয়া উচিত। পত্রিকাটির এমন মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় পূর্ব বাংলায়। ১৯৫২ সালের আজকের দিনে (৯ ফেব্রুয়ারি) এর প্রতিবাদ করে ছাত্ররা। গ্রহণ করা হয় নিন্দা প্রস্তাব। তাদের তরফে বলা হয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রাদেশিকতা বা রাষ্ট্রদোহিতার কোন সংস্রব নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোর এমন ভূমিকার প্রতিবাদ করেন মওলানা ভাসানীও। পৃথক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘উর্দুর মতো একটি নতুন ভাষা পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর জোর করিয়াই চাপাইয়া দিতে চাহিলে নিশ্চয়ই এই আশঙ্কাই জনগণের মনে উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে, চাকরি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে কোণঠাসা করিবার জন্যই ইহা করা হইতেছে। একথার বুলি আওড়াইয়া যারা পাকিস্তানে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষার পক্ষে ওকালতি করিতেছেন, আমি তাহাদিগকে দুনিয়ার প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড কানাডার দিকে তাকাইতে বলিতেছি। তথায় একের অধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এবং ইহা দেশের একতা শিথিল করা তো দূরের কথা, দেশবাসীর আর্থিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধনে প্রচুর সহায়তা করিয়াছে।’ একই রকম বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ। ভাষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেন তিনি।
এ সময় বাঙালির দাবির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয় ঢাকার ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে লেখা চালিয়ে যায়। তীব্র সমালোচনা করা হয় খাজা নাজিমুদ্দিনের ভূমিকার। ফলে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত আনুগত্যের অভিযোগ তুলে পূর্ব বাংলা সরকার পাকিস্তান অবজারভার বন্ধ করে দেয়। এভাবে ক্রমশ নিজেদের চেহারা জাতির সামনে তুলে ধরছিল ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তান।
প্রতিবছর ভাষার মাসে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা একাডেমীর বই মেলায় প্রতিদিনই থাকছে নানা অনুষ্ঠানের। শনিবার টিএসসি চত্বরের উন্মুক্ত মঞ্চে আবৃত্তি সংগঠন স্বরকল্পনের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হবে ‘প্রান্তরে হাঁক কবিতার ডাক।’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আশরাফুল আলম, বিশেষ অতিথি গোলাম কুদ্দুছ ও হাসান আরিফ। এছাড়া অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত শিল্পীদের আবৃত্তি পরিবেশনা মঞ্চস্থ হবে।

No comments

Powered by Blogger.