বীরাঙ্গনা ৭১ ॥ মুনতাসীর মামুন- বিজয়ের পরই গণহারে ধর্ষণের বিষয়টি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয়

 ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বাইরে নির্যাতিত নারীদের নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। দেশের অভ্যন্তরে আমরা শুনেছি, নারী নির্যাতনের কথা, কিন্তু তার ভয়াবহতা কতটুকু সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও নীতি নির্ধারকদের।
[মুজিবনগরে] সম্যক ধারণা ছিল কি না সন্দেহ। যুদ্ধ শেষে যখন অবরুদ্ধ মানুষরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন, শরণার্থীরা যখন ফিরে আসছেন তখন ধীরে ধীরে নারী নির্যাতনের চিত্রটা পরিস্ফুট হয়ে উঠতে থাকে। একইভাবে, পাশ্চাত্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পাশ্চাত্যের প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় কখনো কখনো ধর্ষণের খবর যে আসেনি তা নয়, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্ব পেয়েছে শরণার্থীদের বিষয়। লুট, খুন, জ্বালাও পোড়াওর সঙ্গে একই বাক্যে স্থান পেয়েছে ধর্ষণ। পাশ্চাত্যে সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকা। ইউরোপের গণমাধ্যম ‘স্বাধীন’ থাকার চেষ্টা করলেও প্রভাবিত যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা দ্বারা। আমেরিকা তখন পাকিস্তানের গণহত্যাকে সমর্থন করছে। তাদের পক্ষে গণহত্যা ও ধর্ষণে গুরুত্ব দেয়া সম্ভব ছিল না। যে কারণে ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশে গণধর্ষণের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
প্রাচ্যের সংবাদপত্রগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের সংবাদের উৎস ছিল এএফপি, রয়টার ইত্যাদি সংস্থা। চীন তখন গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে সৌদি আরব ও মুসলিম-অধ্যুষিত দেশসমূহ। যেখানে জনচাপের কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কিত সংবাদসমূহ ছাপা হয়েছে, কিন্তু পাশ্চাত্যের মতো বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কারণ অধিকাংশ দেশের সরকার গণহত্যাকে সমর্থন করছিল নিজ নিজ স্বার্থে। এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছিল তাদের মানসিকতায়।
সুসান ব্রাউনমিলার যখন তার বিখ্যাত বইটি লিখছেন তখন নিউইয়র্ক পোস্টে ক্রিসমাসের আগে বাংলাদেশে ধর্ষণের সংবাদ তার চোখে পড়ে। লসঅ্যাঞ্জেলেস টাইমসের সিন্ডিকেটেড সার্ভিস দ্বারা সংবাদটি প্রচারিত হয়েছিল। তাঁর মনে হলো, এ সংক্রান্ত সংবাদ নিশ্চয় অন্য পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি ফোন করলেন নিউইয়র্ক টাইমসে তার এক বন্ধুকে। তাঁর সাংবাদিক বন্ধু জানালেন, ‘বাঙালি নারীদের ধর্ষণ? মনে হয় না। মনে হচ্ছে না এটি টাইমসের কোনো প্রতিবেদন।’ নিউজউইকে ফোন করেও একই উত্তর পেলেন। সুসান লিখেছেন,I got the distinct impression that both men, good Journalists, thought I was barking up an odd tree.
ব্রাউনমিলার লিখেছেন, ওই সময় এনবিসি টেলিভিশনের লিজ ট্রটা স্বল্প কয়েকজন মার্কিন সাংবাদিকদের একজন যিনি এ বিষয়ে তদন্তমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন।
একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ভারতীয় সংবাদসমূহ।
তবে সেখানেও ধর্ষণ বা নির্যাতিতের কাহিনীর চেয়ে শরণার্থীদের দুর্দশার বিবরণ ছাপা হয়েছে বেশি।
পাশ্চাত্যে ১৯৭২ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি বাংলাদেশে গণধর্ষণের সংবাদটি গুরুত্ব পেল। কীভাবে বিষয়টি ক্রমে গুরুত্ব পেল তার বিবরণ আমরা পাই সুসান ব্রাউনমিলারের গ্রন্থে।
ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চের এশিয়া বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন রেভারেন্ড কেনতারে বুমা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর দুই সপ্তাহের সফরে এসেছিলেন তিনি বাংলাদেশে। সফর শেষে জেনেভাতে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে জানালেন, গত ৯ মাসে পাকিস্তানী সৈন্যরা ২০০,০০০ বাঙালী নারীকে ধর্ষণ করেছে। এ সংখ্যা তাঁকে জানিয়েছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। হাজার হাজার বাঙালী নারী অন্তঃসত্ত্বা। তিনি আরো জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্য অনুসারে, কোনো নারী ধর্ষিত হলে স্বামী তাকে গ্রহণ করে না। তবে বাংলাদেশ সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সেই ঐতিহ্য ভাঙার। স্বামীদের তারা জানাচ্ছে, এই নারীরা ভিকটিম এবং তাদের অবশ্যই বীরাঙ্গনা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কেউ কেউ স্ত্রীকে ফেরত নিয়ে গেছেন তবে তার সংখ্যা কম। ব্রাউনমিলার মন্তব্য করেছেন, A story that most reporters couldn’t find in Bangladesh was carried by AP and UPI under a Geneva dateline. Boiled down to four paragraphs, it even made in the New York Times.”
এরপর ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন ‘হিউম্যানিটোরিয়াল ্এ্যান্ড ফেমিনিস্ট’ গ্রুপগুলো তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে লাগল। সুসানের বিবরণ দেখে মনে হয়, তাদের ক্ষোভটি বেশি ছিল সেসব স্বামীদের বিরুদ্ধে যারা তাদের নির্যাতিত স্ত্রীদের গ্রহণ করতে চাইছে না। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনী যারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা ক্রোধ তেমন প্রকাশিত হয়নি। হ্যাঁ, তারা সমব্যথী ছিল বাঙালী নারীদের প্রতি কারণ তাদের স্বামীরা প্রদর্শন করছিল,Blindness of men to injustices they practice against their own women. ১১ জন মার্কিন মহিলা এ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসে এক চিঠি লিখে।
তবে এ বিষয়ে সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের লন্ডন অফিস। যে সব বিদেশী সংস্থা এক্ষেত্রে সহায়তা দিতে চেয়েছিল তাদের সহায়তা সংহত করে কর্মসূচী গ্রহণ করে প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড। তারা নির্যাতিতাদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার পাঠায় বাংলাদেশে। এ রকমই একজন হলেন ডা. জিওফ্রে ডেভিস। তিনি শুধু ডাক্তারের নৈর্ব্যক্তিক মন নিয়েই বিষয়টিকে দেখেননি, মানবিকতার দিক থেকে সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে বিবেচনা করেছিলেন। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.