লেখার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই

ওরহান পামুক, ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আনত্মর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক। উদারপন্থী তুকর্ী এই সাহিত্যিকের রয়েছে সহনশীলতা, স্বাধীনতা ও অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মতো ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, যার পরিচয় মেলে তাঁর লেখায় বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধকে অনুরণনের মাধ্যমে।
পূর্ব-পশ্চিম প্রথাগত সম্পর্কে বিতৃষ্ণ এই লেখক নিজেকে দুই বিশ্বের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। পামুক এমন এক ঔপন্যাসিক, যাঁর সাহিত্যের নান্দনিকতার উৎস তাঁরই ভালবাসার শহর ইসত্মাম্বুল। অন্য বিখ্যাত পশ্চিমা সাহিত্যিকদের থেকে তিনি আলাদা। অতীত ইতিহাস ও মনুষ্যত্বই তাঁর সাহিত্যের মূল অনুপ্রেরণা। সত্যভাষণে নিভর্ীক পামুক ২০০৫ সালে নিজ দেশে কারাবরণ করেছেন অপ্রিয় সত্য বলার জন্য। 'মাই নেম ইজ রেড', কিংবা 'দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স'-এর মতো আনত্মর্জাতিক বেস্টসেলারসহ পামুকের আটটি উপন্যাসই তাঁর সাহিত্যিক হিসেবে অসাধারণত্ব এবং মানুষ হিসেবে বিশালত্বের পরিচয় বহন করে। সমপ্রতি মুম্বাইয়ে 'দি হিন্দু' পত্রিকার নির্মলা লক্ষণের সঙ্গে ওরহান পামুকের কথা হয়। কথোপকথনের বিষয় ছিল পামুকের 'দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স'সহ অন্যান্য গ্রন্থ, তাঁর মানুষকে আবিষ্কার করার চেষ্টা এবং দেশপ্রেম। ওরহান পামুক ও নির্মলা লক্ষণের কথোপকথনের বাংলা অনুবাদ করেছেন _ কুন্তল রায়
নির্মলা: তুর্কী ভাষায় লেখা আপনার প্রথম দিকের গ্রন্থ 'দি হোয়াইট ক্যাসল', 'দি বস্ন্যাক বুক', 'মাই নেম ইজ রেড' থেকে শুরম্ন করে পরে 'বস্নু', 'ইস্তাম্বুল' এবং 'দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স', সব ক'টিতেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। রয়েছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট, সুন্দর-অসুন্দর। আপনার সাহিত্যের প্রকাশ অগণিত কণ্ঠের মধ্য দিয়ে, বহুমাত্রিক এবং বহুধা বিস্তৃত; মনে হয় যেন আপনার সাহিত্যের ল্য সম্ভাব্য সবকিছুই তুলে ধরা। এটাই কি সাহিত্যিক হিসেবে আপনার ল্য?
পামুক: আপনার প্রশ্নে মনে হচ্ছে আমি এমনই এক উচ্চাকাঙ্ৰী লেখক যে জগতের সকল মহান বিষয়ই তুলে ধরতে চায়, এবং হঁযা, আমি তাই করতে চেয়েছি (হাসি)। 'মাই নেম ইজ রেড' বইতে আমি একটি জাতির অন্তর্শক্তিকে দেখাতে চেয়েছি, সংস্কৃতির সত্যকে প্রকাশ করতে চেয়েছি। 'দি ব্ল্যাক বুক'-এ আমি এই শক্তিকেই ইস্তাম্ব্বুলের দৃষ্টিতে ইতিহাসের প্রহেলিকার মধ্য দিয়ে খুঁজেছি। 'ব্লু'-তে একই সংস্কৃতিকে উদ্ঘাটন করেছি রাজনীতির মধ্য দিয়ে।
'দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স'-এ এই শক্তিকেই আমি খুঁজে ফিরেছি প্রেমের মধ্য দিয়ে। আমি হয়ত গোটা দেশের চিত্র দেখাইনি, কিন্তু আমার দেখা অ-পশ্চিমা দুনিয়া এখানে ফুটে উঠেছে যেখানে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক অবৈধ, যেখানে নারীর কুমারীত্বকে সম্পদ হিসেবে ধরা হয়। এই বইটি চীন, স্পেন, ইতালি, গ্রীসসহ গোটা ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সমাদৃত হয়েছে। জামর্ানি ও যুক্তরাষ্ট্রেও অনেকে এটি পড়েছে। আমি তুরস্কের সমাজকে দেখালেও প্রকৃতপক্ষে এটি এমনই এক নিষ্পেষিত সমাজের দৃশ্য যেখানে চাইলেই প্রেমে সফলতা আসে না। এটা উপনিবেশউত্তর অ-পশ্চিমা বুজের্ায়া সমাজের রোমিও-জুলিয়েটের মতো কাহিনী, কিন্তু এখানে আধুনিকতার অনুপ্রেরণা আছে, আছে ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে কিভাবে ইতিহাস বেড়ে ওঠে।
ক্যাসিকাল ইসলামী প্রেমের ক্ষেত্রেও একই বিষয় ল্য করা যায়। এমনকি সত্তরের তুরস্কে উচ্চবিত্ত বুজের্ায়াদের মধ্যেও প্রেমিক যুগলেরা দেখা করে কথা বলতে কিংবা মেলামেশা করতে পারত না। ১৯৭০ সালে তুরস্কের ওই সব মেয়ে 'খদ্দের'ও পেত না (হা! হা! হা!)। তা বলে এগুলো আমি নেতিবাচকভাবে বিচার করিনি। বরং খুঁজতে চেয়েছি নতুনত্বকে। প্রেমের ক্ষেত্রে যদি বাধা থাকে, আমেরিকার মতো চাইলেই প্রেমিক-প্রেমিকারা কথা বলতে না পারে, তবে তারা নিজেদের মধ্যে বোধগম্য ভাষা তৈরি করে নেয়। এই ভাষা খুব সহানুভূতিশীল; চোখের চাহনি, নীরবতা, অঙ্গভঙ্গি কিংবা ভুরম্ন কোঁচকানো এ সবই এ ভাষার অংশ, প্রেমের প্রকাশভঙ্গি।
কামাল আর দশজন প্রেমিকের মতো প্রতিরাতেই ফুসানকে দেখে। যদিও তাদের মধ্যে চোখে চোখ রাখার সুযোগ বলতে গেলে নেই। একমাত্র কামাল যখন ফুসানের পেইন্টিংগুলো দেখতে যায়, তখন কিছুটা একাকী সময় কাটাতে পারে। এটা এমনই এক নিষ্পেষিত সমাজ যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকাদের অনত্মরঙ্গ মেলামেশার কোন সুযোগ নেই। এর মধ্যেই ভাবের আদান-প্রদানের জন্য নিজেদের বোধগম্য ভাষার দরকার হয়। আমি 'দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্সে' ভিন্ন জিনিস ভিন্ন উপায়ে দেখানোর চেষ্টা করেছি। মাঝেমধ্যে একে অতিনাটকীয় মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই আমার আবিষ্কার।
নির্মলা: আপনি তো নিজের একটা মিউজিয়াম গড়ে তুলছেন। কেমন এগুচ্ছে ওটা?
পামুক: হঁ্যা, ভালই চলছে। ইসত্মাম্ব্বুলে অনেক মানুষ এটার পেছনে কাজ করছে। অনেক স্থপতি, কারিগর এটার পেছনে কাজ করছেন। কামালের মতো আমিই আমার জাদুঘরের কিউরেটর। অনেক কষ্ট হচ্ছে জাদুঘর তৈরিতে কিন্তু এই কাজে অনেক আনন্দ পাচ্ছি।
নির্মলা: আমার মনে হয় 'দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স' আপনার খুব প্রিয় একটা বই। ভারতে অনেকেই এটা খুব পছন্দ করে।
পামুক: হঁ্যা হঁ্যা আমি জানি (স্মিত হাসি)। বইটি লেখার সময় আমি আমার বন্ধুদের বলতাম, আমাকে মানুষ এই বইটির জন্য মনে রাখবে। এটা এই অর্থে আমার প্রিয় বই যে, লেখার সময় আমি খুব আনন্দ পেতাম, যেমনটা এখন জাদুঘর তৈরিতে আনন্দ পাচ্ছি। যদিও লেখার সময় ছিল প্রতিকূল, আর রাজনৈতিক চাপও ছিল। তারপর নোবেল পুরস্কার পেলাম, নানা ঘটনা...পরিবর্তন। কিন্তু কি যে শানত্মি পেলাম! আমি যেদিন এই বইয়ের এক পাতা লিখতে পারতাম, সেদিন থাকতাম খুব সুখী একজন মানুষ। আবার এটা এজন্যও আমার প্রিয় বই যে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এটা লেখা। আমি যেসব জায়গায়, যে রেস্টুরেন্টে বা সিনেমা হলে গেছি, কামালকেও আমি সেখানে নিয়ে গেছি। ইসত্মাম্বুলের হিলটন হোটেলের অসংখ্য বিয়ের অনুষ্ঠানে কামালকে আমি নিয়ে গেছি। গল্পের সব কাহিনীই আমার নিজের জীবন থেকে নেয়া।
নির্মলা: 'স্নো' ছাড়া আপনার সব উপন্যাসেই আপনি ইসত্মাম্ব্বুলে ফিরে গেছেন; সেটা আজকের ইসত্মাম্ব্বু্বুলই হোক আর অতীতের ইসত্মাম্ব্বু্বুলই হোক। যেন মনে হয়, আপনি ইসত্মাম্ব্বুলের হৃদয়কে ধারণ করে আছেন।
পামুক: ওহ..হঁ্যা। আমি তাই মনে করি (হাসি)। মাত্র কয়েকটি বছর ছাড়া আমি ৫৪ বছর ধরে সেখানেই আছি। আমি ওখানে মানবতাকে চিনেছি, জীবনকে দেখেছি, তারপরই ইসত্মাম্ব্বুলকে নিয়ে লেখা শুরম্ন করেছি। আমি ইসত্মাম্বুলকে ভালবাসি। কারণ আমি এখানে জন্মেছি এবং আমি, আমি হয়েছি।
নির্মলা: তাহলে কি এটাই মনে হয় না যে, একজন লেখকের লেখায় তখনই সত্যভাষণ ভেসে ওঠে যখন সে তার শেকড়ের অনুসন্ধান করে, যে সমাজ বা সাংস্কৃতিক প্রোপট থেকে সে বেড়ে উঠেছে? একজন লেখকের েেত্র এ বিষয়টি কি অনেক গুরম্নত্বপূর্ণ?
পামুক: হঁ্যা এবং না। নির্দিষ্টতা, অনন্য বৈশিষ্ট্য যে কোন উপন্যাসের জন্য গুরম্নত্বপূর্ণ। কিন্তু লেখা তখনই আকর্ষণীয় হয় যখন কোন একটি সংস্কৃতি সর্বজনীন সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করে। সেই সাহিত্যই হৃদয় কাড়ে যে সাহিত্য সবার হৃদয়ের কথা বলে। আমি সেই ধরনের লেখক। আমি এমন ধরনের লেখক হতে চাই, সেই অর্থে যে আমি ইসত্মাম্বুলের রং, গন্ধ, রূপ অনুভব করতে পারি। তখন এটাও আমার মাথায় থাকে যে পৃথিবীর সব মানুষই আসলে একই রকম, যদিও তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ভিন্ন। এজন্যই ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিম-লের মানুষ ভিন্ন আচরণ করে। এই বিষয়গুলো আমি সাহিত্যে উপস্থিত রেখেছি, আমার গল্পে রাখার চেষ্টা করেছি। সর্বজনীন এবং নিজস্ব বিষয়গুলো পৃথকভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি।
নির্মলা: নোবেল বক্তৃতায় আপনি বলেছেন, 'আমি মনে করি না যে, এখনও ল্যে পেঁৗছাতে পেরেছি।' এখন কি আপনি ল্যে পেঁৗছেছেন?
পামুক: হঁ্যা। আমি যখন লেখা শুরম্ন করি, কেউই তুরস্ক সম্পর্কে জানত না। ১৯৮৫ সালে আমি দুই বছরের জন্য আমেরিকা যাই এবং 'দি বস্ন্যাক বুক' লিখতে আরম্ভ করি। যখন বুঝতে পারি আমার কণ্ঠ জোরালো হয়ে উঠছে, আমি ভাবতে শুরম্ন করি 'এসব লাতিন আমেরিকান লেখক খুব সৌভাগ্যবান; কে তুকর্ী বা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা একজন ভারতীয় বা পাকিসত্মানী লেখকের কথা চিনত্মা করে? আমি তখন এমনই চিনত্মা করতাম। কিন্তু গত ২৫ বছরে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি এতে খুশি। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক কারণে গোটা বিশ্বেই পরিবর্তন এসেছে। তখন তুরস্ক কিংবা ভারতের সাহিত্যিকরাও দৃশ্যমান হয়েছেন। যেমন সালমান রম্নশদি ১৯৮১ সাল থেকেই দৃশ্যপটে এসেছেন।
নির্মলা: এই সময়ে নয়া জাতীয়তাবাদের যে উত্থান তাতে কি আপনার মনে হয় না যে অসিহষ্ণুতা, ভিন্নমত সহ্য করার মতা, সেন্সরশিপের প্রবণতা বেড়ে গেছে? আপনি নিজেও এর শিকার হয়েছেন।
পামুক: নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, আমাকেও এজন্য জেলে ভরতে চেয়েছিল, কিন্তু আনত্মর্জাতিক চাপের কারণে বাদ দেয়। এটা একটা দিক। কিন্তু গত ১০ বছরে তুরস্ক অনেক মুক্ত সমাজে পরিণত হয়েছে। এখানে স্বাধীনভাবে কথা বলা যায়, সেনাবাহিনীসহ প্রতিষ্ঠানসমূহের সমালোচনা করা যায়। এটা আরেকটা দিক। আপনি সাধারণভাবে বলতে পারবেন না, রাষ্ট্রযন্ত্রের মতা বাড়ছে। দুর্বল ব্যক্তির কন্ঠস্বর জোরালো হচ্ছে। যখন জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে, অধিকাংশ েেত্র উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে সম্পদ বাড়তে থাকে। সরকারের এলিট শ্রেণী, সেনাবাহিনী, বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণী সবার হাতেই সম্পদ বাড়তে থাকে। আবার যেহেতু গোটা জাতিই অগ্রসর হচ্ছে, সম্পদশালীদের পাশাপাশি মুক্তচিনত্মাও বাড়ে, যারা ভিন্নমত পোষণ করে তাদের সংখ্যাও বাড়ে। তখন ীণ কণ্ঠও শক্তিশালী হয়, দুর্বলের গলায় জোর বাড়তে থাকে। তখন ীণ কণ্ঠও শক্তিশালী হয়, দুর্বলের গলায় জোর বাড়তে থাকে। মুক্তচিনত্মা করে এমন একটি সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। আপনি একজনকে জেলে পুরতে পারবেন, কিন্তু পুরো জাতিকে জেলে পোরা কি সম্ভব? সব সময়ই কেন্দ্রীয় কতর্ৃত্ব থাকবে। আমি হতাশাবাদী নই, কিন্তু শাসকশ্রেণী সে তুর্কীই হোক আর হিন্দুই হোক, তারা কতর্ৃত্ববাদী হবে। আবার সেই সমাজে সংখ্যালঘু শ্রেণীর দাবি-দাওয়া থাকবে। কর্তৃপরে সঙ্গে একাত্মতা পোষণ না করায় সংঘর্ষও বাড়বে। তখন কিভাবে ভারসাম্য রা হবে সেটাই গুরম্নত্বপূর্ণ।
নির্মলা: মানুষের স্বাধীনতাকে নষ্ট করে যারা সেন্সরশিপ প্রতিষ্ঠা করে, তার প্রতিবাদ করা কি লেখক-বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব?
পামুক: অবশ্যই এটা সাহিত্যিকের কাজ, কিন্তু সমাজের প্রতিটি জনগণেরও। আপনি যদি প্রকৃতই শিা নিয়ে থাকেন এবং বোঝেন পৃথিবী কিভাবে চলছে, আপনার অবশ্যই দায়িত্ব আছে। কিন্তু আমি ওটা বলতে চাই না যে, লেখকদের অন্য কাজের চেয়ে রাজনীতি গুরম্নত্বপূর্ণ। আমাদের পূর্ববতর্ী তুর্কী লেখকরা খুবই মানসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু তাঁরা রাজনীতি শুরম্ন করে শিল্পকে ধ্বংস করে দেন। এটা খুবই বাজে রাজনীতি। ঐ অর্থে আমি রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমার মূল উদ্দেশ্য খুব ভাল, সুন্দর উপন্যাস লেখা। রাজনীতি নয়। যদিও আমি বিশ্বের এমন এক সমস্যা জর্জরিত অংশে বাস করি যেখানে সবাই রাজনীতির কথা জানতে চায়। কিন্তু আমি উপন্যাসের মাধ্যমে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি না। আমি মাঝেমধ্যে সাাতকার দিয়ে এ সবের উত্তর দিই এবং তারপরই আমি সমস্যায় পড়ি (হা হা হা)।
নির্মলা: তুর্কী আইনের অনুচ্ছেদ ৩০৩-এর এখন কী অবস্থা? এই আইনের অধীনেই তো আপনাকে তুর্কী জাতীয়তাবাদের অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল, যখন তুরস্কে কুর্দী ও আর্মেনিয়ানদের হত্যার বিরম্নদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন।
পামুক: অনুচ্ছেদ ৩০১ পরিবর্তন করা হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে কিংবা ভুল করে, তারা আমার মতো আর কাউকে আর শাসত্মি দেবে না (হাসি)। এখন বিচার বিভাগের অনুমতি না পেলে কোন বিখ্যাত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হবে না। অর্থাৎ আমি পার পেয়ে যাব, কিন্তু আপনি পাবেন না। (হা হা)।
নির্মলা: 'বস্নু'তে আপনি বিপুলসংখ্যক চরিত্র নিয়ে এসেছেন এবং সত্যকে ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।
পামুক: 'বস্নু'র কাহিনীর সবকিছুই সত্য_ এ দাবি আমি করব না। কিন্তু উপন্যাস বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। ঔপন্যাসিকের কাজ কোন রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক উত্তর খোঁজা নয়। আমি কি 'স্নো'তে সেই চেষ্টা করেছি? মোটেই না। আমি একজন দর্শক হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনকে দেখেছি। কিন্তু কারও সঙ্গে একমতও হইনি। 'বস্নু'তে 'বু' চরিত্রটি আমার নিজের কোন দৃষ্টিভঙ্গি নয়। সমাজের মানুষ কিভাবে দেখে সেটাই আমার ল্য। যেমন ধরম্নন 'বু'র যুক্তি হলো 'আমরা অ-পশ্চিমারা কেন নেকটাই পরব?' গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নেকটাই ও পশ্চিমাদের মধ্যে কি সম্পর্ক? এখানে প্রশ্নটাই গুরম্নত্বপূর্ণ, আমি এটা উপস্থাপন করেছি, কিন্তু এ উত্তরের সঙ্গে আমার মতের মিল নাও হতে পারে।
নির্মলা: 'দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স' আপনার সবচেয়ে অসাধারণ, অভিনব কাজ। আপনি কি এর কোন সিকু্যয়েল লেখার চিনত্মাভাবনা করেছেন।
পামুক: না, আমার হাতে অন্য একটা উপন্যাস আছে। সত্তরের ইসত্মাম্বুলের একজন রাসত্মার হকারকে নিয়ে এর কাহিনী গড়ে উঠেছে, যে তার কাজ হারায়। আমার আরও একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আছে। আমার মাথায় অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। তবে লেখার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আমার কোন চিনত্মা নেই। আমি আপাতত পরবর্তী উপন্যাসের মাঝামাঝি আছি। আমি খুশি যে 'মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স' মানুষ পছন্দ করেছে এবং সারা বিশ্বে এটি খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু সিকু্যয়েল লেখার মধ্যে আমি নেই।
নির্মলা: নোবেল পুরস্কার আপনার মধ্যে কি কোন পরিবর্তন এনেছে?
পামুক: নোবেল পুরস্কারের স্বীকৃতি প্রকৃতপ েআমার প্রাত্যহিক জীবনকে তেমন পরিবর্তন করতে পারেনি। লেখা, লেখা এবং লেখা; এতেই আমার শানত্মি। লেখার মাধ্যমেই আমি পরিচিত হয়ে উঠেছি। আমার বই ৪৬টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে, এখন মনে হয় ৫৬টা ভাষায় হচ্ছে। আমার ল ল পাঠক। আর এজন্যই আমার সময় কমে গেছে, আমাকে লেখার প্রতি আরও মনোযোগী হতে হয়েছে। আমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। যদি আমি বলি একটা ভাল উপন্যাস লিখছি; তাহলে এটা অনত্মত ৩৫টি দেশে প্রকাশিত হবে। এজন্যই আমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। তারপর আমার মনে পড়ে আমি অ-পশ্চিমা এবং উপনিবেশউত্তর বিশ্ব নিয়ে লিখি, যখন লাতিন আমেরিকা, ভারতীয় বা চীনারা এই লেখাকে তাদের নিজেদের কথা বলে মনে করে। আমার এটা প্রচন্ড ভালো লাগে। এ এক অসাধারণ ব্যাপার। প্রাচ্যের লোকেরা আমাকে নিজেদের লেখক ভাবে। এজন্য লেখার ৰেত্রে আমি তাদের কথা মনে রাখি। নিজেকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল মনে হয়।
নির্মলা: তার মানে আপনার মতো লোকদের দায়িত্বশীলতা অনেক?
পামুক: দেখুন, নোবেল পুরস্কার আমার অনেক দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে এটা বুঝতে পারি এবং আমি এটাকে নষ্ট করতে চাই না। আমার সব দায়িত্বশীল বন্ধু রাজনীতিতে ঢুকেছেন, কিন্তু আমি বাড়ি বসে উপন্যাস লিখি। আবার শিল্পের সৃজনশীলতার জন্য কিছুটা দায়িত্বহীনতার দরকার আছে। অতিরিক্ত বাধ্য-বাধকতা সাহিত্যকে নষ্ট করে দেয়।
নির্মলা: কিন্তু ভারতের মতো সমাজে আপনি কিভাবে দারিদ্র্য, বিভাজনকে আগ্রাহ্য করবেন?
পামুক: অগ্রাহ্য করা যাবে না। সমাজে এটা থাকবে। তার মানে এটাই একমাত্র জিনিস নয়। আমি এভাবেই দেখি। আমার সাহিত্যে আমি পুরো দৃশ্যপটের ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করি। সাহিত্যের স্বাধীনতায় বিশ্বাস রাখুন, এটা আপনাকে সফলতা এনে দেবে।
নির্মলা: আপনার প্রিয় লেখক কারা?
পামুক: অনেক। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জীবিত লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। আমার সব সময়ের পছন্দের সাহিত্যিক ৪ জন_ তলসত্ময়, দসত্ময়েভস্কি, টমাস মান এবং মার্সেল প্রাউস্ট।
নির্মলা: আপনি তুকর্ী ভাষায় লেখেন। অথচ অনুবাদের ফলে আপনার সাহিত্যের মাধুর্য, কাব্যময়তা হারিয়ে যায় না।
পামুক: এটা ঠিক। আমি তুর্কী এবং সারাজীবন এই ভাষায় লিখতে চাই। আমি শেষ জীবনে এসে ইংরেজী শিখেছি। এজন্য বিশ বছর ধরে সমস্যায় ভুগেছি। আগে একজন অনুবাদক খুঁজে পেতাম না, কোন প্রকাশক আমার বই ছাপতে চাইত না। ৪০ বছর বয়সে আমার প্রথম বই ছাপা হয়েছে_ ভাবতে পারেন? প্রকাশকরা যখনই আমাকে দেখত তখনই বলত, ও তো তুর্কী, ওকে ভুলে যাও। এখন আমি আমার বই এবং অনুবাদকদের নিয়ে খুশি। অনুবাদকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার প্রচুর অর্থ খরচ হয় (হাসি)। লেখক হওয়া অনেক কষ্টের বিষয়, কিন্তু এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই।

No comments

Powered by Blogger.