স্তম্ভ by মাখরাজ খান

গাড়িয়ালের বউ জোসনা। মা-বাবা মরা মেয়ে, গ্রামের মানুষ আর ভাই-বোনেরা মিলে তাকে তিন মাইল দূরের এই গাড়িয়ালের হাতে তুলে দিয়েছিল। কত বছর আগে তার মনে নেই।
এখন কিছুই তার মনে থাকে না। মাঝে মাঝে সে ভাবে তার হয়তো মনই নেই, মন থাকলে সেখানে সুখ থাকে, দুঃখ থাকে, ভালবাসা থাকে, রাগ-রঙ্গ, মান অভিমান, কামনা-বাসনা কত কী থাকে, জোসনার এখন এসব কিছুই নেই। সে থাকে রাস্তার ধারে একটা পর্ণ কুটিরে, সারাদিন ভিক্ষা করে। সন্ধ্যায় ইটের ওপর ইট তোলা চুলায় ভিক্ষার চাল রান্না করে আর রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দ্যাখে। তার ঘরের চাল ফুটোÑসেখান দিয়ে জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলো আসে আর বৃষ্টির সময় জলের ঝাপটা এসে তার ঘরের ভাঙ্গাচোরা ছেঁড়াফাড়া জিনিসপত্র ভিজিয়ে দেয়।
জোছনা ঘুমায় একটা বাঁশের মাচার উপর। বন্যায় ভেসে আসা পুরনো কয়েকটি বাঁশ যোগাড় করে নিজেই তৈরি করেছে। এখান থেকে দেড় মাইল দূরে মানিকগঞ্জের পাকা সড়ক, রাতে নির্ঘুম অবস্থায় সে বাস-ট্রাকের আওয়াজ শুনতে পায়।
আর বিছানায় শুয়ে ভাঙ্গা চালের ফোকর দিয়ে আকাশ দেখে বিড়বিড় করতে থাকে। নিজের সাথেই নিজে কথা বলে। কত কথা, আসমানের ঐ উজ্জ্বল তারাটি তার সঙ্গী। সঙ্গী আসমানে আর সে মাটিতে। এত দূরে থাকলে কি কথাবার্তা বলে সুখ আছে! কোনো কোনো রাতে সে বিড়বিড় করতে করতে ঘরের বাইরেও আসেÑকি পচাগরম আর চারদিকে নিঃস্তব্ধতাÑএই নিঃস্তব্ধতার মধ্যে তার মনে স্মৃতির লহর ওঠে। রাস্তায় একা একা হাঁটে কলাগাছে বাদুড় ঝাপটায়, ধানক্ষেত্রে ব্যাঙেরা ঘ্যা-গো করে।
এই ধান ক্ষেতেই একাত্তর সালে সে পালিয়ে ছিল। তখন সবেমাত্র তার বিয়ে হয়েছে মহর গাড়িয়ালের সঙ্গে; দূর, স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই, বলত তার দাদি আমির জান। গরুর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতÑ ফিরতে রাত হয়Ñ কোন কোন সময় রাত গিয়ে ভোর হয়ে যেত, তারপরÑ ফিরে আসত গাড়িয়াল। রাত বিরেতে একা ঘরে তার ভয় করত পাশের ঘরের শামসু বুড়ো হুঁকা টানতে টানতে খুঁক খুঁক করে কাশত কাশির শব্দে সাহস ফিরে পেত জোসনা। তারপর গাড়িয়াল আসত কোনদিন সূর্য ওঠার আগে, কোনদিন পরে।
মনে হয় এই তো সেদিনের কথা কিন্তু কত বছর চলে গেছে, তিন যুগ দুই বছর এই ধান ক্ষেতের আইলের ওপর দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতÑ গরুগুলোকে জাম গাছের সাথে বেঁধে রেখে, তখনও ধান ক্ষেতটি যেমন ছিল এখনও তেমনি আছেÑ একদিন ভোরে শোনা গেল মিলিটারী আসছে? এর আগেও দু’একবার শোনা গেছে মিলিটারী আসছেÑ এক রাতে তো জোসনা হিজল গাছের ওপর বসেই কাটিয়ে দিয়েছিল সারারাত। আজও শোনা যাচ্ছে মিলিটারী আসছেÑ হিজল গাছ অনেক দূরে এবার পালাবে ধান ক্ষেতে। জোসনা মনে মনে বলে, ঠিক সেই সময় ঘোমটার আড়াল থেকে দেখল দৈত্য দানবের মতো মিনিটারীর দল। ওরা যুদ্ধ করে, শত্রুর বুকে গুলি চালায়Ñ শুনেছে ওদের চোখে মুখে প্রতিহিংসার আগুন কিন্তু এখানে শত্রু কোথায়? এখানে গুলি চালাবে কাদের ওপর? তার সামনের জাম গাছটার গায়ে হাত দিয়ে গাছের গা ঘেঁষে দাঁড়াল সে, গাছটা এখন কত বড় হয়েছে। তার সমান বয়সী। গাছটাকে বলে সে সখি। সখি তোর কি মনে আছে? আলবত মনে আছে কেন থাকবে না, মানুষ ভুলে যেতে পারেÑ তুই ভুলবি কি করে? পাশের বাড়ির জরিনার তিন মাসের ছেলেটাকে ঐ পশুরা তোর গায়ে ছুড়ে মেরে দিল, আর ছেলেটা চিৎকার করার আগেই নিথর হয়ে গিয়েছিল। জরিনার কাপড় টেনেÑ মহেলার হাত ধরে, সখিনার পাছায় লাথি মেরে নিয়ে গিয়েছিল ডোবার পাড়ে, তারপরÑ তারপর তো তুই দেখেছিস্; ‘তোর চোখে এ বুড়ো বাকলের পরতে পরতে সে দৃশ্য লেগে আছে। ওরা চলে যাওয়ার পর আসে রাজাকাররাÑ আমি মনে করেছিলাম ধানক্ষেত্রে কেউ আসবে না, কিন্তু এলো। আমাকেও তারাÑ সখিনা, মহেলার মতো নষ্ট করল। ওদের ধর্মের বাপ বলেও রেহাই পেলাম নাÑ আল্লা রসুলের দোহাই দিয়েও ওদের হাত থেকে বাঁচতে পারলাম না। ইজ্জত গেল সাথে সাথে মুখের জবানও গেলÑ এখন কথা বলি আ-আ করে, কোনা শব্দ বুঝা যায় না। আমার দেহ তো পচে গেছেÑ জবান বিকৃত হয়েছে; স্বামী তালাক দিয়েছে। এখন স্বামীর ঘরে ঠাঁই নাই, এ রাস্তার পাশে বাস করি। ভিক্ষা করিÑ আ-আ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খয়রাত চাই।
সখি তুই-ই ভাল তোকে মানুষের কাছে হাত পাততে হয় না। মাটি থেকে রস আর বাতাস থেকে খাদ্য নিয়ে বেঁচে আছিস। আমার হয়েছে জ্বালাÑ আমার হাতও পাততে হয়, ভিক্ষা না দিয়ে কেউ আমার চরিত্র নিয়ে কথা বললেÑ মাথা নিচু করে চলে আসতে হয়। আমার কি দোষ, বল? একাত্তর সালে রাজাকাররা আমার ইজ্জত মারলÑ স্বামী আমারে ভুল বুঝে ছেড়ে দিলÑ আমি অতই যদি খারাপ হতাম; আবার নিকে বসতে পারতাম, পাড়ায় গিয়ে নাম লিখাতে পারতাম। মাটি কামড় দিয়ে স্বামীর ভিটেয় থাকতে চেয়েছিলাম, তাও যখন পারলাম নাÑ এই রাস্তার ধারে ঘর করলাম।
সখি লো রাস্তা দিয়ে মানুষ যায়, কত কথা বলেÑ কেউ গান করে, কেউ দ্যাশের খবর, সাথীকে শোনায়। যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর ছিলÑ তাদের নাকি বিচার হবে?
দোসরদের আমি চিনিÑ ওরা আমার মতো কত নারীর ইজ্জত নষ্ট করেছেÑ কত নারীর ঘড় ভেঙ্গেছে। আমি ওদের নাম দিয়েছি ধর্ম ডাকাত। ধর্মের নামে ওরা ডাকাতি করেছে, একেকবার মনে হয়Ñ চুলার গনগনে আসুন ওদের মুখে নিক্ষেপ করি। আমার চুলায় যতটুকু আগুন আছেÑ অন্তত একজনের মুখ তো পুড়বে। মুখ পুড়ে দিবÑ তারপর মুখপোড়ারা মরবে। মরে দোজখের আগুনে জ্বলবে।
আম গাছের ওপর বসা একটা পাখি ডেকে ওঠে। ওই পাখির শব্দ জোসনার কাছে মনে হয়Ñ তার কথা শোনেÑ সহানুভূতি প্রকাশের ভাষা।
বীরাঙ্গনাদের তো সবাই সহানুভূতি দেখায়, কেউ খোঁজ খবর নেয় না। বিস্ফারিত নয়নে সে চেয়ে থাকে অন্ধকারের দিকেÑ জোনাকী পোকার আলো দেখা যায়Ñ ডোবার পাড় ঘেঁষেÑ না ওটা জোনাকী পোকার আলো নাÑ ভূতের বাতি; রমিজউদ্দিনের স্কুলপড়ুয়া ছেলে বলে আলেয়ার আলো। উপর আলো ফোটে ওঠার পর আবার ভাল করে দ্যাখে সেই ডোবার পানিÑ না কোনো আলো নেই। চোখের ধান্ধাই, চোখও তার সাথে প্রতারণা শুরু করেছে। রাতের জগৎ আর দিনের জগতের কত তফাত। রাতে শুয়ে শুয়ে কখনো ঘর ছেড়ে জামগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভাবে রাজাকারদের মুখে চুলার আগুন দিব, একটা ঘৃণাস্তম্ভ তৈরি হবে সকাল বিকাল ঐ সব দুশমনদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য, দিনে সে ধামা নিয়ে বের হয় ভিক্ষায়, বাড়ি বাড়ি ঘুরে, আগে করুণ কণ্ঠে সাহায্য চাইত, এখন আর ভিখ-মাঙতে গিয়ে কোনো কথাই বলে না। ঘৃণা স্তম্ভও তৈরি করা হয় না। রাস্তার পাশে অবশ্য কয়েক দলা শক্ত এঁটেল মাটি এনে রেখেছে সেই চৈত্র মাসে। এখনো মাটির দলাগুলো তেমনি পড়ে আছে কাবেলের বউ চুলা বানানোর জন্য নিতে চেয়েছিল জোসনা দেয়নি।
- জোসনা বু, মাটি দিয়া তুমি কি করবা?
- কাম আছে।
কাবেলের বউ জানেÑ বেশি কথা বললেÑ জোসনা বু ক্ষেপে যাবে, তার চেয়ে কি কাম জেনে নেয়া ভাল।
Ñ ঘিরনা কাম।
কাবেলের বউ বুঝে নাÑ কি করে শুধু থুথু, যারা পান খায় পানের পিক আর ছেঁড়া স্যান্ডেল আর জুতা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে একটা স্তম্ভ করা যায়? মাটি দিয়ে হাঁস-মুরগির খোঁয়ার বানানো চলে তাও সেখানে বাঁশের কঞ্চি লাগে। চুলা তৈরি করা যায় সেখানে পাট কুচি কুচি করে কেটে দিতে হয়, ঘিরনা স্তম্ভ ওদের বাবা, কি শক্ত কথা মুখ দিয়ে বের হতেই চায় না।
জোসনার ঘিরনা স্তম্ভের কথা এতদিনের সবাই জেনে গেছে, কেউ তাকে হেসে ঠোঁট ভেঁচকিয়ে হাসে, কেউ দুঃখ প্রকাশ করেÑ ছেলেরা ওর নাম দিয়েছে ঘিরনা বুড়ি। জোসনা সব বুঝে যারা তাকে দেখে টিটকারি করে তাদেরও কিছু বলে না, তারা সহানুভূতি দেখায় তাদের কিছু যায় না। এখন তার হাঁটাচলা আগের চেয়ে ক্ষিপ্র গতিতে। রাস্তায় চলার সময় ডান বাঁয়ে তাকাবার অবসর নেই।
রাস্তার পাশে জোসনা যেখানে এঁটেল মাটির দলাগুলো রেখে ছিল তার চারপাশে উইপোকা বাসা বেঁধেছে এই উইগুলোইÑ এখন তার বন্ধু মুখ ফসকে দু’একজনের কাছে ঘৃণা স্তম্ভের কথা বলে সে তো শুধু কিছু মানুষের ঠোঁট উল্টানোই দেখল, উইপোকারা তাকে সাহায্য করতে এসেছে, সে কিন্তু তাদের বলেনি।
জামগাছটা যেমন তার সখি, ঘরের বাতায় যে ইঁদুরটা থাকে, সেও তার সখা। গাছে যে পাখিটা মধ্যরাতে ডাকে, যে তার সাথী। পাখি মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে বলে বিচার হবে, বিচার হবেÑ পাখির ভাষা শুধু জোসনাই বোঝে সে আত্মবিশ্বাসী হয়, সাহস ফিরে পায়। রহমতের বাড়িতে টেলিভিশন আছে, টেলিভিশনে যুদ্ধের মধ্যে যারা মানুষ মারছে, নারীর ইজ্জতও মারছে, তাদের বিচারের কথা বলছে।
পাখিও বোধহয় শুনছে টেলিভিশনের কথা। পাখিরা আকাশে উড়ে তো ওরা সব জানে, বৃষ্টি নামার আগে বুঝে, ঝড়ের পূর্বাভাস পায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথাও জানে ওরা। জোসনা পাখির ডাক শোনেÑ আগে রাতে ডাকতÑ এখন দিনেও ডাকে। উইপোকারও ঢিবিটা ক্রমে বড় হচ্ছেÑ তার রাখা মাটিগুলো মিশে গেছে উইপোকার ঢিপির সাথে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একটা মদা কুকুর ওখানে পিছনের এক পা উঁচু করে প্রস্রাব করে গেলÑ জোসনা মনে করল আজ ভিত্তি স্থাপন হলো। মূত্র উদ্বোধন হলো। রজাকার ঘৃণা স্তম্ভের।
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ওখানে একটা বদ বু-পায় মানুষ। থুথু ফ্যালে থুথুগুলো এসে পড়ে উইপোকার ঢিবির ওপর?
জোসনা সকালে ওঠে ভিক্ষায় বের হওয়ার আগে একবার খক খক করে কেশে ঐ কাশি ঢিপির ওপর ফেলে যায়, আবার সন্ধ্যায় এসে থুথু ফেলে ওখানে, সারাদিন সে আর কোথাও থুথু ফেলার প্রয়োজন হলেও ফেলে না। জমিয়ে রাখেÑ জোসনা মনে মনে ভাবে একদিন বমি করতে পারলে ভাল হতোÑ আর সঙ্গে একটা সাইন বোর্ড। ঘৃণা স্তম্ভ এখানে সবাই থুথু ফেলুন, পানের পিক ফেলুন, বমিও করতে পারেন। ওয়াক ওয়াক করে।

No comments

Powered by Blogger.