ভোরবেলায় জ্যান্ত মাছ ও টাটকা সবজির স্বল্পস্থায়ী বাজার by ড. আর এম দেবনাথ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অনেকদিন যাবত ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি পড়াই। সেই সূত্রে অনেক ছাত্রের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। এরা পাশের আগে ‘ইন্টার্নশিপ’ করার জন্য সুপারিশ করতে বলে বিভিন্ন ব্যাংকে।
যতটুকু পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করি। পরীক্ষা পাসের পর অনেকেই ফোন করে চাকরির তদ্বির করতে। এটা আমি পারি না। আবার মাঝে মাঝে অনেক প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়। জিজ্ঞেস করতেই অনেক ছাত্র বলে, বেসরকারী খাতে চাকরি করছে। এর মানে ব্যাংক-বীমা-বহুজাতিক সংস্থা নয়। এসবে ভাল বেতন, বিশেষ করে যারা পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে পারে। তদ্বিরে ঢুকলেও মোটামুটি ভাল বেতন পাওয়া যায়। বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা তো বটেই। তবে এসব বেতনের চাকরির খবর কম পাই। বেশিরভাগই বলে ছোট ছোট প্রাইভেট কোম্পানির কথা, আবাসন কোম্পানির কথা, গার্মেন্টস শিল্পের কথা। কিন্তু যখন বেতনের কথা তারা বলে তখন বড় আঘাত পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ’ থেকে পাস করা বিবিএ, এমবিএ ডিগ্রীধারী ছেলেমেয়েরা কিনা বেতন পায় সাত-আট-নয়-দশ হাজার টাকা। কেউ কেউ একটু বেশি পায়। তবে এদের সংখ্যা কম। এ ধরনের বেতনের কথা শুনে আমি নির্বাক হই। অনেক বিএ-এমএ পাস করা ছেলেমেয়ে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করে ৪-৬ হাজার টাকা মাসিক হিসেবে। একটি ছেলের খবর পেলাম সে নাকি দুপুর বেলায় নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মন্দির ইত্যাদির খাবার খায় তার সংসার চলে না বলে। এই তো গত মঙ্গলবারের ঘটনা। মৌচাক বাজারে গেছি ঘুরতে। বলা বাহুল্য, অনেকদিন পর। দেখি একটি সুতি মোজার দোকান। দুটো ছেলে দোকানে বসা। মোজার দাম নির্ধারিত। দর কষাকষির কোন সুযোগ নেই। বৃহত্তর ফরিদপুরের ছেলে দুটোকে জিজ্ঞেস করি, তোমরা কত বেতন পাও? বলতে চায় না। বুঝলাম ৪-৫ হাজার টাকা মাসিক বেতন। জিজ্ঞেস করে জানলাম অনেক দোকান কর্মচারী আছে যাদের মাসিক বেতন ২-৩ হাজার টাকা। ছেলে দুটোর বয়স কত হবে? কুড়ির নিচে। বললাম, তোমরা রাস্তায় সবজি বিক্রি কর না কেন, তোমরা রাস্তায় মাছ বিক্রি কর না কেন? কেন ফলমূল বিক্রির দিকে যাও না? কোন উত্তর নেই। একজন পীড়াপীড়িতে বলল, ব্যবসা করতে পুঁজি লাগে, সেটা নেই। আমি বললাম এসব দোকানের জন্য বেশি পুঁজি লাগে না। নানা প্রশ্ন নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসি। লক্ষ্য করি লেখাপড়া জানে না সেই ছেলেও চাকরি চায়। সিকিউরিটি গার্ড হতে চায়, ফ্ল্যাট বাড়ির রিসেপশনে বসতে চায়, অফিসে বসতে চায়। কিন্তু প্লাম্বার, বিদ্যুতমিস্ত্রি, ফ্রিজ মিস্ত্রি, টেলিভিশন মেকানিক হতে চায় না। এসব দেখি আর আমাদের শিক্ষামন্ত্রী জনাব নাহিদের কথা ভাবি। তিনি এবং তাঁর পূর্বসূরি মন্ত্রীরা এমন শিক্ষাব্যবস্থার কর্ণধার যেখান থেকে কেরানি ছাড়া কিছুই বেরোয় না। এমন কী লেখাপড়া না জানলেও সে চাকরি চায়। নিদেন পক্ষে অফিসের পিয়ন।
এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সদ্য উক্ত কয়েকটা কথার কথা মনে হয়। তিনি বলছেন, আমাদের স্বউদ্যোগী কর্মী-ব্যবসায়ী দরকার। আগামী দিনে বুড়ো মানুষের সংখ্যা বাড়বে। তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ব্যবস্থা দরকার। আরও অনেক কথা। সেসবে যাব না। আমি স্বউদ্যোগী কর্মী-ব্যবসায়ী দরকারÑএই কথাটিই একটু আলোচনা করতে চাই। ধরা যাক মাছের ব্যবসার কথা। শান্তিনগর কলোনি বাজারসহ অনেক বাজারে মাছের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। তাদের দোকান আছে। তারা এক টাকার মাছ দুই টাকায় বিক্রি করে। প্রতিবাদ করলে এক জেলার সকল ব্যবসায়ী পারলে দা নিয়ে আসে কাস্টমারকে মার দেয়ার জন্য। মুরগির দোকানেও তাই। সবজির দোকানেও তাই। তারা একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ নিচ্ছে। ঢাকা শহর বড় হয়েছে, হচ্ছে। অথচ প্রতিষ্ঠিত বাজারের সংখ্যা কম। যে শান্তিনগর কাঁচাবাজারে আগে শত লোক বাজার করত এখন করে হাজার লোক। যে কুল বড়ই এই বাজারে ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়, ভ্যান গাড়িতে সেই একই কুল ১০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়। প্রতিটি জিনিসেই তাই। কলা বলুন, মুলা বলুন, ফুলকপি বলুন, বেগুন বলুনÑসবকিছুরই একই অবস্থা। হাউজ বিল্ডিংয়ের পাশে ফুটপাত দখল করে একটা নির্দিষ্ট জেলার ফল ব্যবসায়ীরা চুটিয়ে ব্যবসা করছে। তাদের আচার-ব্যবহার কী রকম তা কেবল মাত্র ভুক্তভোগী ক্রেতারাই জানেন। বস্তুত নির্দিষ্ট দোকানের স্থায়ী দোকানদার, কাঁচাবাজারীরা সাধারণ ভোক্তাদের বলতে গেলে দাম-মূল্য দিয়ে নির্যাতন করে। এটা তারা করতে পারছে কারণ চাহিদা বেশি, দোকানি কম। সরকারের পক্ষে শত শত বাজার তৈরি করা একদিনে সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় স্বউদ্যোগী যুবকরা নেমে পড়ুক ভ্যান নিয়ে আলুর খুচরা দোকানদারিতে। ফলমূল, শাকসবজি, টাটকা মাছ ইত্যাদির ব্যবসায় তারা নামুক। কলকাতায় দেখেছি পাড়ায় পাড়ায় দোকানিরা টাটকা মাছ নিয়ে যায়। ফরমালিনের ব্যাপার নেই। বাজার থেকে দামে সস্তা। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাছ কেটে দিয়ে যায়। সেখানে ২৫০ গ্রাম মাছও বাড়ির লোকেরা নেয়। এই হকাররা বিক্রি করে। আমাদের দোকানদারদের ২৫০ গ্রাম মাছের কথা, আলুর কথা বললে তারা দা নিয়ে আসবে। একটা বাজে কথা বলে অসম্মান করে দেবে। যার যতটুকু প্রয়োজন তা টাটকা খেতে হলে অল্প অল্পই বাজার করতে হবে। ঢাকায় এটা সম্ভব নয়। এখানে কেজিতে, দুই কেজিতে হিসাব। বড় বড় ব্যাপার।
সেদিন খুবই ভাল লাগল এক রিকশাওয়ালাকে দেখে। অল্প বয়স্ক রিকশাওয়ালা। দেখি ফুল প্যান্ট, হাফশাট পরা, পায়ে জুতা। এমন না যে এগুলো জরাজীর্ণ। মোটামুটি ভাল জামা-কাপড়। ছেলেটিকে দেখেই আমার সন্দেহ হলো। বললাম তোমার বাড়ি কোথায়? উত্তরÑ কিশোরগঞ্জ। বলে কী, কিশোরগঞ্জের রিকশাওয়ালা। দেখে তো মনে হয় তুমি ভাল ঘরের, রিকশা চালাও কেন? স্যার চাকরির জন্য ঘুরেছি। পেয়েছি, দেড় হাজার টাকা বেতন। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। এক বছর করার পর রিকশা নিলাম। দিলে ৫০০-৬০০ টাকা রোজগার করলাম। এই যে রিকশাটা দেখছেন এটা আমার নিজের। সারাদিন রিকশা চালাই না। সকালে বের হই। দুপুরে ফিরে যাই। বিকেলে আবার নামি। রাত ৯-১০টা পর্যন্ত কাজ করি। বিশ্রাম নেই। দিনে কমপক্ষে ৪০০ টাকা থাকেই। মাসে হয় ১২০০০ টাকা। কোথায় ১,৫০০, কোথায় ১২০০০ টাকা। ও বলে ইচ্ছে আছে একটা দোকান দেব। টাকা জমাচ্ছি। তোমাকে কেউ সাহায্য করেছে। না স্যার। রিকশা কেনার সময় কিছু ধার করেছিলাম। তা দিয়ে দিয়েছি। এখন আমার দেশের একটা ছেলে মাছ বিক্রি করে রাস্তায়। ওর সঙ্গে পার্টনারশিপ করছি। সেখান থেকেও দিনে ২-৩ শত টাকা পাই।
মুহিত সাহেব কথিত স্বউদ্যোক্তা এরা। এদের পেছনে গ্রামীণ ব্যাংক নেই, ব্র্যাক নেই, প্রশিকা নেই। এমন কী নেই কোন সরকারী অথবা বেসরকারী ব্যাংকও। তারা লোন দেয় ‘এস আলমকে’, ‘মোনেমকে’, মেঘনা গ্রুপকে, অমুক গ্রুপকে, তমুক গ্রুপকে। দুই হাজার, চার হাজার, দশ হাজার টাকা দিলে হাজার হাজার ছেলে ভ্যান গাড়িতে পানিতে ভাসা রুই-কাতলা বিক্রি করতে পারে। দিতে পারে হোম-সার্ভিস, ফর্মালিনমুক্ত, কম খরচে। শান্তিনগর মোড়ে ভোর ছ’টায় কাঁচাবাজার বসে রাস্তার ওপর। মাছ, মুরগি পাওয়া যায়। সবই টাটকা। পুলিশ পেটায়। তবু তারা বসে। মানুষও যায়। যায় কারণ কাঁচামাল দারুণ টাটকা, মাছ জ্যান্ত, ফর্মালিনমুক্ত। সবচেয়ে বড় কথা সস্তা। নির্ধারিত শান্তিনগর বাজার থেকে কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ সস্তা। এসব দোকানির আচার-ব্যবহার ভাল। পুলিশ পেটায়, টাকা আদায় করে। তবু তারা বসে। আটটার মধ্যে বাজার শেষ। ফুটপাথ খালি। এরা স্বউদ্যোক্তার উদাহরণ। সরকারের সাহায্য নেই, পেটানি আছে। ব্যাংকের সাহায্য নেই। এনজিওর সাহায্য নেই। স্বউদ্যোক্তারা দুই ঘণ্টা কাজ করে ভালই রোজগার করছে। শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় নাহিদ ভাই, আমি বুঝি না প্যান্ট পরে রাজশাহীর জ্যান্ত কাতলা, রুই পাড়ায় পাড়ায় ভোর বেলা বিক্রি করতে আপত্তি কোথায়? আত্মসম্মানটা সিলেবাসে ঢোকানো যায় না? আমি যে জিনিসটা বোঝাতে চাইছি ঢাকা শহর, বড়ছোট শহর, উপজেলা পর্যায়ে হাজার হাজার ধরনের ছোট ছোট কাজ-পেশা-জীবিকা আছে যাতে পুঁজি লাগে কম, রিটার্ন বেশি। অফিসের চাকরি, সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির চেয়ে বেশি তো বটেই। সরকার এসব কাজকে উৎসাহিত করে না কেন? সরকার খালি বড় বড় চিনতা করে। ৬০টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৭০টা মেডিক্যাল কলেজ, ৮০টা ডেল্টাল কলেজÑএসবই সরকারের চিন্তা। এটা যে কেরানি বানানোর কাজ তা তো সরকার বোঝে না। প্রাইভেট মেডিক্যালের ডাক্তার না কি ইনজেকশন দিতে জানে না এমন বললেন আমার এক বন্ধু। সরকারকে বলব টেকনিক্যাল ম্যানপাওয়ার বাড়াতে। আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি, এখানে দু’জন প্লাম্বার কাজ করে। এরা সমিতির বেতনভুক। কাজ করলে টাকা দিতে হয় না। তবু ফ্ল্যাটের মালিকরা খুশি হয়ে দশ-বিশ টাকা দেয়। তবু দেখি এরা দুই-তিন মাস পর থাকে না। অত্যন্ত বেশি বেতনে চলে যায়, বিদেশ চলে যায়, সাপ্লাইয়ের কাজ শুরু করে, স্বাধীন পেশায় যোগদান করে, দোকান দিয়ে দেয়। দেশে দরকার এ ধরনের টেকনিক্যাল লোক যারা হবে স্বউদ্যোক্তা। ব্যাংকে ব্যাংকে দেখা যায় হাজার হাজার মহিলা উদ্যোক্তা । যত বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানি, তার মালিকরা ম্যানেজিং ডিরেক্টর। স্ত্রী চেয়ারম্যান, মেয়ে পরিচালক, জামাই পরিচালক। এই অর্থে দেশ ভর্তি মহিলা উদ্যোক্তা দিয়ে। আমি এ ধরনের মহিলা উদ্যোক্তার কথা বলছি না, আমি বাপ-দাদার সুবাদে উদ্যোক্তা ছেলেমেয়ের কথা বলছি না। আমি বলছি না প্রকৃত উদ্যোক্তার কথা যারা শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে গড়ে তুলবে ব্যবসা। এদের সাহায্য দরকার, এদের পুঁজি দরকার। এদের স্পেস দরকার। মজার বিষয় এদের কিন্তু ব্যাংকের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। ব্যাংকগুলো কম্বল দেয়, কিছু টাকা সাহায্য দেয় কর্পোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি হিসেবে। এসবের কোন মূল্য আমার কাছে নেই। দরকার মানুষকে স্বাবলম্বী করার ব্যবস্থা। ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হোক এসব করতে। তা কেউ করবে কী? মনে হয় না। স্বউদ্যোক্তা তাহলে কোত্থেকে হবে? আমরা সস্তায় জ্যান্ত মাছ, তাজা মাছ খেতে চাই, ফর্মালিনমুক্ত মাছ-ফলমূল খেতে চাই। তাজা সবজি খেতে চাই। আমরা শহরবাসী হোমসার্ভিসের সুযোগ চাই এসব ব্যাপারে। যেহেতু ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ও স্থায়ী বাজার খুবই কম চাহিদার তুলনায়, যেহেতু স্থায়ী দোকানদাররা অতিরিক্ত দাম চার্জ করে, যেহেতু তারা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সেইহেতু সারা ঢাকায় ভোর বেলার বাজার চাই। ফুটপাথে ৬টায় বাজার বসবে, ৮টায় বন্ধ হবেÑ এর কোন ব্যতিক্রম নেই। এতে ভোক্তারা অনেক নির্যাতন থেকে বাঁচবে। আমরা পাড়ায় পাড়ায় হোমসার্ভিস ব্যবস্থায় সবজি, মাছ, মুরগি, ডিম ইত্যাদি চাই। সৃষ্টি হোক গরিব ছোট ছোট স্বউদ্যোক্তা। শত শত কোটি টাকার পুরুষ মালিকের স্ত্রীকে, কন্যাকে বিনা অবদানে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চাই না। ব্যাংকগুলো নারী উদ্যোক্তাদের কিছু সাপোর্ট করতে চায়। এর সুযোগ নিতে অনেক অতি চালাক পুরুষ তাদের কন্যার নাম ব্যবহার করছে। স্ত্রীর নাম ব্যবহার করছে বলে খবর আছে। এই নারীরা বস্তুত ব্যবসার কিছুই জানে না। কাগজে সই করে মাত্র। এ ধরনের উদ্যোক্তা কী আমরা চাই? মনে হয় না।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.