ভারত মহাসাগরের পাড়ে তিন পা by মোস্তাফা জাব্বার

বিমানবন্দর থেকে শহরে যাবার পথে রাসত্মার দু'ধারের বাড়িঘর খুব উন্নত একটি জাতির ঠিকানা দেয় না। সাধারণ মাপের ঘরবাড়ি। হাইরাইজ ভবন নেই।
কিন্তু আমি জানি, এখন তাদের জনপ্রতি আয় আমাদের দ্বিগুণ, প্রায় চৌদ্দ শ' ডলার। কলম্বোর স্কাইলাইনও ঢাকার মতো নয়। হিল্টনের মতো দু'চারটি ভবন কেবল আকাশ ছুঁয়েছে। অন্য সব ভবন পুরনো ধাঁচের-দু'তলা-তিনতলা। আমি এর আগে বার কয়েক কলম্বো এসেছি। তখনও তামিল টাইগারদের সঙ্গে কলম্বোর সরকারের যুদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার আগের চাইতে অনেক বেশি চেকপোস্ট চোখে পড়ল। হিল্টন হোটেলের গেটে একটি আর্মি চেকপোস্ট। যার তার আইডি চেক করা হয়। ধারণা করি, আরও কিছুদিন আগে অবস্থা নিশ্চয়ই আরও নাজুক ছিল। কারণ আমাদের যাবার কদিন আগেই প্রভাকরণসহ তামিল গেরিলাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের যবনিকাপাত হলো। এখন আর শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ নেই। হয়ত সেজন্যই মানুষের চোখেমুখে এখন আর আতঙ্ক নেই। তবে বাজার এলাকা ছাড়া রাসত্মায় খুব বেশি মানুষ চোখে পড়ে না। বরং বলা যায়, সাবধানতা আছে। হয়ত এজন্যই ছুটির দিনেও কলম্বোর গলেফেসে তেমন ভিড় হয় না। মধ্যবিত্ত কিছু মানুষকে সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে হাঁটতে দেখা যায়।
আমরা হিল্টনে আসার অনেক পরে, প্রায় মধ্যরাতে হিল্টনে এলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক জনাব মাহফুজুর রহমান। সাহিদুল মুনির মধ্যরাতে মাহফুজ সাহেবকে আনতে বিমানবন্দর গিয়েছিল। আমরা তাকে নিয়ে শ্রীলঙ্কার লঙ্কা গভ নেটওয়ার্ক দেখব। সম্ভব হলে ক্যান্ডি্ যাব এবং আরও কিছু সরকারী কাজকর্ম দেখব। কোরিয়ার এক্সিম্প ব্যাঙ্কের সরল ঋণে সেখানে প্রকল্পটির প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরম্ন হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ বছরের শেষ নাগাদ এমন একটি প্রকল্প, বাংলা গভ নেটওয়ার্ক শুরম্ন হতে যাচ্ছে। আমরা যখন শ্রীলঙ্কা যাই তখন আমাদের প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ছিল। এরপর চুক্তি সই, টেন্ডার আহ্বান ইত্যাদি সেরে ২০০৯ সালের শেষে এটির কাজ শুরম্ন হতে পারে। মোট পাঁচ বছরের এই প্রকল্পটি দেশের সকল জেলা ও বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হবার পাশাপাশি ঢাকার সরকারকে অনত্মত ৩০টি উপজেলার সঙ্গেও যুক্ত করবে। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে রাবণের লঙ্কায় যাবার প্রধান কারণ সেই লঙ্কা গভ নেটওয়ার্ক সম্পর্কে চাুষ ধারণা পাওয়া। ঢাকায় বসেই আমরা শ্রীলঙ্কার সরকারী দফতরের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলাম।
সেই মোতাবেক লঙ্কা গভ নেটওয়ার্কের প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পর্কে জানার জন্য ১০ আগস্ট ২০০৯ সকালে আমরা শ্রীলঙ্কার ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন টেকনোলজি এজেন্সির অফিসে পেঁৗছাই। এটি বাংলাদেশের কম্পিউটার কাউন্সিল বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সমক প্রতিষ্ঠান। এর নিয়ন্ত্রক সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপতি। অফিসটিকে কোনভাবেই একটি সরকারী অফিস মনে হলো না। প্রায় ফাইভ স্টার হোটেলের সুযোগ-সুবিধায় সাজানো অফিসে তেমনই কাজকর্মের পরিবেশ। একটি প্রেজেন্টেশন রম্নমে আমরা শ্রীলঙ্কার প্রকল্প সম্পর্কে ব্রিফিং পেলাম। প্রকল্প পরিচালক একজন মহিলা_তার নামের শুরম্নটা দিল শব্দটি দিয়ে। জানতে চাইলাম, দিল মানে কি হৃদয়? মহিলা হাসতে হাসতে বললেন হঁ্যা। মহিলার বয়স ৫০-এর কাছে। তিনি আমেরিকায় থাকতেন। দেশে তার কেউ নেই। স্বামী বিদেশে থেকে হাঁপিয়ে ওঠেন। তাঁর সঙ্গে তিনিও দেশে চলে আসেন। তিনি জানালেন, বিদেশের তুলনায় এক দশমাংশ বেতন ও সুবিধায় তারা স্বামী-স্ত্রীতে শ্রীলঙ্কায় রয়েছেন। প্রকল্পটিকে তিনি একটি স্বপ্নপূরণ বলে মনে করেন। এর দ্বিতীয় পর্যায়েও কাজ করার ইচ্ছে তাঁর আছে। তিনি মনে করেন যে, শ্রীলঙ্কা সরকারকে একটি ডিজিটাল সরকারে রূপানত্মর করতে এই প্রকল্প ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। শতকরা দেড়ভাগ সুদে দণি কোরিয়ার সহায়তায় শ্রীলঙ্কা এই প্রকল্প বাসত্মবায়ন করছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্যও দেড় ভাগ সুদ রয়েছে। মাহফুজ সাহেব জানালেন, বাংলাদেশ সেই তুলনায় ভাগ্যবান। কারণ বাংলাদেশ একই ঋণ পাচ্ছে শ্রীলঙ্কার এক তৃতীয়াংশ সুদের হারে।
এই প্রকল্পটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক আমার কাছে মনে হলো ভিওআইপি। এই প্রকল্পের অধীনে যেসব অফিস আছে সেইসব অফিসে ভিওআইপি ব্যবহার করা হয় এবং এজন্য সকলেই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে বিনে পয়সায়। কল সেন্টারে কল করতেও কোন বিল দিতে হয় না। শ্রীলঙ্কায় ভিওআইপি বৈধ। ফলে সরকারের কাছ থেকে কোন লাইসেন্স নিতে হয় না। ইন্টারনেট প্রটোকলে যে কেউ আইপি ফোন ব্যবহার করতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে আইপি টেলিফোনের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। মোট ৩২টি আইএসপি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেবার সিদ্ধানত্ম হয়েছে। পত্রিকার খবর অনুসারে প্রথম বারেই ১২টি প্রতিষ্ঠানের হাতে লাইসেন্স হসত্মানত্মর করা হয়েছে। তবে লাইসেন্স দেয়া হলেও আমরা এখনও জানি না কবে নাগাদ আমাদের আইএসপিগুলো আমাদের ইন্টারনেট টেলিফোন সেবা প্রদান করবে। কবে যে আমি আমার নিজের অফিস বা ইন্টারনেট প্রটোকলে বিনা পয়সায় কথা বলতে পারব সেটি বলা কঠিন। তবে আমাদের সরকারী অফিসগুলো যদি তাদের নিজেদের মাঝে আইপি টেলিফোনি ব্যবহার করে তবে সরকারের ফোন বিলের সাশ্রয় হবে কোটি কোটি টাকা।
আইসিটিএ অফিস থেকে আমরা কলম্বোর একটি জেলা অফিস দেখতে গেলাম যেখানে জন্ম, মৃতু্য ও বিবাহবিষয়ক প্রত্যয়নপত্র প্রদান করা হয়। আমাদের অবাক করে দিয়ে জানানো হলো যে, মাত্র দশ মিনিটে যে কেউ সঠিক কাগজপত্র প্রদান করে প্রত্যয়নপত্র নিতে পারে।
সেখান থেকে আমরা গেলাম লঙ্কা গভ নেওটয়ার্কের অপারেশন সেন্টারে। ছোট একটি অফিস। জনা দশেক লোক কাজ করছে। কাজের নমুনা দেখে বোঝা যায় ওদের কাজের মাত্রাটি উচ্চমার্গীয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কোরীয়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম_ওদের বেতন কত। জানাল, ৫০০ থেকে ১৫০০ ডলার ওদের মাসিক বেতন। একজন কোরীয় এবং বাকি সবাই শ্রীলঙ্কার। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এমনকি ভিডিও করা নিষেধ। আমরা কয়েকটি স্থির ছবি তুলতে পারলাম। পুরো দেশের নেটওয়ার্ক পরিচালনায় তারা একদিকে হেল্প ডেস্ক চালাচ্ছে, অন্যদিকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে। দেশজুড়ে রয়েছে স্থানীয় পার্টনার। সেইসব পার্টনার প্রয়োজনে সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.