রাসূলের আদর্শ সব যুগের অনুসরণীয় by সালমা সেতারা

মিরাজ সম্পন্ন হয় নবুওতের চতুর্থ বর্ষে রজব মাসের ২৭ তারিখে। মিরাজের অর্থই ঊর্ধ্বারোহণ বা ঊর্ধ্বগমন। আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্য ছিল মিরাজকে উপলক্ষ করে ইসলামের জীবনবিধানকে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপদান করা। আদম (আ.) থেকেই ইসলাম পৃথিবীতে এসেছে।
কিন্তু দুই লাখ চবি্বশ হাজার নবী-রাসূল-পয়গম্বর আসাকালীন ইসলামের কোনো বাধ্যতামূলক পালনীয় আদেশ বা নিষেধ ছিল না। আল্লাহ পাককেও ইলাহি-ইলাহ বলে ডাকা হতো। এই মিরাজ সংঘটিত হওয়ার পরই নির্ধারণ করা হয়েছে অবশ্য পালনীয় আদেশ ও নিষেধাবলি। পাঠকমনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এখন কেন মিরাজের কথা অসময়ে লেখা হলো? মনে হওয়াটা খুব স্বাভাবিক, কারণ আমরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বিষয়কেই নির্দিষ্ট দিবসের ফিতায় বেঁধে রেখে দিকনির্দেশনা মতো চলি। ফলে যা হওয়ার তা-ই ঘটে চলেছে।
আমরা যদি আমাদের ধর্মীয় বিধান, যা মিরাজের রাতে নবী পাক (সা.)-এর নবুয়ত সূত্রে এসেছিল মানবের কল্যাণে তা যদি অনুপুঙ্খ অনুসরণ করি প্রত্যহ যাপনে তাহলে সমাজে এত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো না। আমরা জাতি হিসেবে নিতান্তই দিবস সর্বস্ব। এ দিবস সর্বস্বতাই মনে হয় আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য জানার এবং মানার পথে অন্তরায় হয়ে পড়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মনুষ্য চরিত্রে যে মানবিক উপাদান দিয়ে, সৃষ্টির সেরা সম্মানে সম্মানিত করেছেন তার কতটুকু আমরা সংরক্ষণ করতে পেরেছি আমাদের বর্তমান চরিত্রে, তা মনে হয় সব ভাবনার ওপরে প্রকট হয়ে, আমাদেরই ব্যঙ্গ করছে। আমরা মিলেনিয়ামের রোবোটিক চরিত্রে অবস্থান করছি গোটা মানবজাতি। বিভ্রান্তি এই যে, রোবট যেমন মানুষের দেওয়া নির্দেশনা হারালে নিজের কর্মপরিধি অতিক্রম করে ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করে, তেমনিভাবে আমরাও করছি। ফলে আমাদের চরিত্রে রাসক্যালিটি ভর করেছে। আজ আমরা মিরাজ সংঘটিত হওয়ার ৬১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১২ খ্রিব্দাব্দে এসে পেঁৗছেছি। আমাদের মানবিকীকরণের ফর্মুলা ঠিক কতটা যৌক্তিকতার আলোকে নিটোল সভ্যতায় মজবুত গ্রন্থনা হয়েছে? যুক্তি, তর্ক, তথ্যপ্রযুক্তি, বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা কি ফলিয়ে চলছি না? কী দর্শন করছি না? তথ্যপ্রযুক্তির ঘোড়াকে ছুটিয়ে চলেছি 'বোরাক', 'রফ রফ'-এর অনুকরণীয় গতিতে, তবু জীবনের শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো সমাধান মিলছে না কেন? কারণ আমরা শুধু গতিটাকেই বিজ্ঞানের আবিষ্কার ভেবে গ্রহণ করেছি। আল্লাহ পাকের নির্দেশকে হৃদয়ঙ্গম করিনি, যা আল্লাহ পাক মিরাজের মাধ্যমে তার প্রিয় রাসূলে পাক (সা.)-এর হাতে পাঠিয়েছিলেন মানবকল্যাণের আদর্শ ও বার্তাস্বরূপ।
মিরাজের বার্তা তথ্য ও আদেশ-নিষেধ, যে কথাগুলোকে একত্রে আমরা 'তাৎপর্য' বলে থাকি, অবশ্যপালনীয় নির্দেশগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ প্যাকেজ হিসেবে, মানুষের পার্থিব বয়সসীমার অন্তর্বর্তী জীবনে আসতেই থাকবে মিরাজ দিবস নামে। একদিন পালনের নিমিত্তে বা আলোচনার খাতিরে নয়, বরং অবশ্যই জীবনে প্রয়োগ এবং দৈনন্দিন বিশ্বাসের সঙ্গে লালন করার জন্য।
হাদিস সূত্রে জানা যায়, মিরাজের রাতে আল্লাহ পাক তার রাসূল (সা.)-এর মাধ্যমে ১৯টি বিধান দিয়ে মানবের কল্যাণে দীনকে পূর্ণাঙ্গ করেছেন। আমরা মিলেনিয়ামের মানবজাতির উত্তরসূরিরা ওই বিধানগুলোর কতটুকু পালন করছি সেটাই মূলত খতিয়ে দেখার সময় আমাদের সামনে দণ্ডায়মান। আমাদের আচরিত কর্মকাণ্ডের কাছে আমরা জিজ্ঞাসিত!
আমরা মিলেনিয়ামের প্রজন্মকে ঠিক কীভাবে গড়ে তুলছি? তারা কি শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্মে পরিপূর্ণ সংস্কৃতিবান? নাকি ক্রমেই চরিত্রের বিনাশ, সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা, মানুষে মানুষে সদ্ভাবের অনুপস্থিতি, অপরিমেয় লোভ, অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই অমিতাচার? যা আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর দুটি প্রজন্মকে অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে এনে দাঁড় করে দিয়েছে?
আমাদের শিক্ষা (এডুকেশন) সুউচ্চ আকাশ ছুঁয়েছে। উচ্চশিক্ষার পর আর কতটা উচ্চতা বাকি রয়ে গেল যে, শিক্ষা 'সুবীদ' হলো না? এতসব জাতিক-আন্তর্জাতিক শিক্ষা নিতান্তই কী অর্থে আর অবৈধ ইচ্ছা পূরণের অপুষ্টিতে ভুগছে? আসলে তা নয়! অপুষ্টি হচ্ছে ধর্মীয় শৃঙ্খলার। শিক্ষার পাশাপাশি অপরিহার্য হতে হবে মানবিক মূল্যবোধ।
কোনো ধর্মই চোর, লম্পট, হত্যাকারী নাস্তিক্যবাদী পরশ্রীকাতর হতে শেখায় না বা সমর্থন করে না। মানবকে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই পরম সত্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন, মানবিক মূল্যবোধ কিসে নিহিত আছে। আমাদের বোঝা না বোঝার দোদুল্যমানতার প্রকৃষ্ট কারণ হচ্ছে ইসলামের ইতিহাসকে চর্চা বা পাঠ থেকে বিরত থাকা। আমরা নোট করে নিয়েছি প্রগতির আরও এক নাম নাস্তিক্যবাদ। আমরা সব বিষয়ে পার্থিবভাবেই বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছি।
তাই ওয়াদাভঙ্গ, ব্যাভিচার, হত্যার বদলে হত্যা, পণ্যদ্রব্যাদির ওজন ও মূল্য, সম্পদ হরণ, যা আমাদের পরিবারের সঙ্গে, রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে ঘটে চলেছে। ওয়াদাভঙ্গকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। নিশ্চয়ই ওয়াদাভঙ্গকারী শেষ বিচারে বিশেষভাবে জিজ্ঞাসিত হবে। এ কর্মটি দেশের সাধারণ তো বটেই, আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্বকারীরাই চরমভাবে অঙ্গীকারের গুরুত্বকে লঙ্ঘন করছেন, যার ফলে দেশের মানুষ একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। নগরের আগুনে তাই মসজিদ, দেবালয় সবই পুড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.