কথ্য বাংলার বিপজ্জনক অবজ্ঞা by বেলাল বেগ

নিউইয়র্কে কন্যার বাসায় বেশ কিছুদিন হলো বাংলাদেশের চারটি টিভি চ্যানেল এসেছে। আমরা স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, আমাদের আমেরিকান নাতি-নাতনিরা এখন শুদ্ধভাবে বাংলা বলা শিখবে।
হা-হতোস্মি! বাংলাদেশের টিভিগুলো থেকে ওরা বাংলা শিখবে কি! ঢাকার বাঙালীরা যে বাংলা বলছে, তার আদর্শ তো আমাদের নাতি-নাতনিরাই। এ উৎকট বাংলার নতুন একটি নামকরণের যেন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান আহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে বলে, বাংলার উপরে ইংরেজীর একটা প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। বাচনিক বাংলা সে প্রভাবটার তোড়ে এক সময় শ্রম্নতিকটু হয়ে 'বাংলিশ' নামে আখ্যায়িত হয়েছিল। বাংলিশে বাংলাই প্রধান ছিল। কিন্তু ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম ছাড়া বাকি পদগুলোও ইংরেজীর দখলে চলে যাবার উপক্রম হওয়ায় 'বাংলিশ' বাংলা ইংরেজী প্রধান হয়ে এবার 'ইংবা' হয়ে গেল। শিক-শিকিা, ছাত্র-ছাত্রী, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী-সাংসদ, সরকারী কর্মচারী, আমলা-সেনা-পুলিশ, উকিল-মোক্তার, ডাক্তার-কবিরাজ, কৃষক-শ্রমিক, রিকশাওয়ালা-ফেরিওয়ালা, প-িত-গবেষক এমন কোন পেশা নেই, যে পেশার মানুষেরা আজ আর শুদ্ধ বাংলা বলে বা বলার চেষ্টা করে। গোদের উপর বিষফোঁড়া ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমগুলো বিশেষ করে টিভি মাধ্যমগুলো। ভাষার প েদাঁড়ানোর অতুলনীয় মতা থাকা সত্ত্বেও ওরাই যেন হৈ চৈ করে বাংলা হত্যায় মেতেছে। অনর্থক ইংরেজীর ফোঁড়ন দিয়ে যারা নিজেরাই বাংলা বলে, অন্যদের উৎসাহ দেয়ার বা বাধ্য করার মতা তারা পাবে কোথায়? টেলিভিশন যেহেতু সবচেয়ে মতাশালী গণমাধ্যম, তাদের সু অথবা কু প্রভাব জনমানসে সর্বাধিক ব্যাপক ও অপ্রতিরোধ্য হয়।
দায়িত্বটা যেন কারও নয়। সকলের এ দায়িত্বহীনতা ও ঔদাসীন্যতার পরিবেশে, ল ল টেলিভিশন, ল ল গৃহফোন, মুঠোফোন, কম্পিউটার, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, মাঠঘাট, হাটবাজার, শেখ মুজিবের সোনার বাংলার প্রতিটি ঘরে (যেখান থেকে যার যা আছে তাই নিয়ে মানুষ একদিন স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে), আজ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ইংরেজী ভাষা আমাদের মাতৃভাষার ওপর সত্মরে সত্মরে আবর্জনার আসত্মরণ বসিয়ে চলেছে। আজ এ মুহূর্তে এ প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে ঢাকার কুট্টি, রাওয়ালপিন্ডির লালকুর্তির মতো বাংলা ভাষাও একটি 'পিডগিন' ভাষা হয়ে যাবে। 'পিডগিন' মানে এমন ভাষা যা পরগাছা ভাষার নিচে চাপা পড়ে যায়।
বাংলার পিডগিন অবস্থা তার বিলুপ্তির প্রথম সত্মর। নানা কারণে মানবজাতির ভাষা মরে যায়। জাতি-বিদ্বেষ, যুদ্ধ, মহামারী, অসহ্য দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, গৃহযুদ্ধ, উন্নত জীবনের প্রত্যাশা ইত্যাদি নানা কারণে দেশানত্মরী মানুষের স্রোত এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। এ হিজরতের বলি হয় মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি। এ প্রক্রিয়ায় মানুষের এক কালের হাজার হাজার ভাষা মরতে মরতে বর্তমানে মাত্র ৬৯০৮টি অবশিষ্ট আছে। এই সেদিন আন্দামানে বো ভাষার একমাত্র ব্যবহারকারী মারা যাওয়ায় ঐ ভাষাটিও মারা গেল। আমরা কি কখনও চাইব আমাদের অনত্মত দেড় হাজার বছর বয়সী ভাষাটির মৃতু্য হোক?
বাংলা ভাষার বিলুপ্তি হবে এমন অলুণে কথা কোন বাঙালী শুনতেও চাইবে না। বিশ্বে মাতৃভাষা রার জন্য প্রাণবিসর্জনের প্রথম ঘটনা বাঙালীই ঘটিয়েছে। এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেল বিজয়ীর আবির্ভাব এ বাংলা ভাষাতেই হয়েছে। মানবজাতির মানবাধিকারের সবচেয়ে শক্তিশালী বাক্য "শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই", তাও প্রথম উচ্চারিত হয়েছে এ বাংলায় চতুর্দশ শতাব্দীতে। এই বাঙালীই তার উদার উচ্চমানবিকতাপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রার জন্য বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছে এবং বিজয়ী হয়ে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য এমন অহঙ্কার কয়টি জাতির আছে! বিশ্বসভা এমন জাতির মাতৃভাষা-শহীদ দিবসকে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে উপযুক্ত সম্মান দিয়েছে। বাঙালীরাই হয়ে গেল পৃথিবীর সকল মানুষের ভাষার যত্ন ও রার দায়িত্ব মনে করিয়ে দেয়ার আদর্শ। এহেন বাঙালী নিজের রক্তার্জিত ভাষাকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ইংরেজীর কাঁটা চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। নিজের এবং স্বজাতির বিরম্নদ্ধে এ অপরাধের জন্য দায়ী কে? কারা এই সংস্কৃতি সন্ত্রাস চালাচ্ছে?
বাংলা ভাষাকে ভেজাল বানানোর কোন বিশেষ ষড়যন্ত্র আছে, এটা বিশ্বাস করা যায় না। এটি আসলে আমাদের শহুরে শিতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসাবধানতা, অবজ্ঞা ও সামগ্রিক হীনম্মন্যতা বোধের ফসল। একুশে ফেব্রম্নয়ারির বিনম্র নগ্নপদ প্রভাতফেরি, উৎসবমুখর বইমেলা সত্ত্বেও এই শ্রেণীর মানুষের অনত্মরে গোপনে বাসা বেঁধে আছে পাশ্চাত্যের ভোগবিলাসময় সংস্কৃতি। দেশীয় সংস্কৃতি ওদের বসার ঘরে কাঁচের শোকেসের একটি রম্নচিসামগ্রী মাত্র। মাটির প্রতি এদের টান বেশি নেই। অথচ এরাই দেশের অধিকাংশ সম্পদ ও দ-মু-ের মালিক। দেশের ভাল-মন্দ এদের মর্জির ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্র-শক্তি-নিয়ামক রাজনৈতিক শক্তিও এই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুষ্ঠিগত। এদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক রাজা-প্রজার। রাজপুরম্নষদের অনুকরণ প্রভু-ভক্তির লণ।
বাংলা ভাষার লিখিত রূপটি কম্পিউটার ও ছাপামাধ্যমের ব্যাপক বিসত্মৃতি এবং বিপুলসংখ্যক লেখক-লেখিকার ক্রমাগত আত্মপ্রকাশের কারণে সহজে পরাভূত হবে না। তবে আজ, এখনই, ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে বাচনিক বাংলার পিডগিন অবস্থা ঠেকান কঠিন হয়ে যাবে।
মুখের ভাষা বাংলাকে তার স্বাভাবিক মর্যাদা ফেরত দিতে হলে সরকারী বেসরকারী দু'প্রকারের ব্যবস্থার যে কোন একটিই হয়ত কাজ দেবে। সরকারীভাবে একটি মাত্র নির্দেশই যথেষ্ট হবে : সরকারের সকল কর্মচারী শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবেন। বাংলার সঙ্গে অকারণ ভেজাল দিলে চাকরিতে অবমূল্যায়ন করা হবে। ব্যস! গ্রামের চৌকিদার থেকে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, প্রাথমিক শিক থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পর্যনত্ম থতমত খেয়ে শুদ্ধ বাংলা বলতে আরম্ভ করবেন। একই সঙ্গে শিা বিভাগ বাড়তি ব্যবস্থা নিলে সোনায় সোহাগা হবে।
বেসরকারীভাবে কথ্য বাংলাকে নিষ্কণ্টক করা একটু কঠিন কারণ সেখানে কারও একক কর্তৃত্ব নেই। তথাপি ব্যক্তিমালিকানাধীন গণমাধ্যমগুলো বিশেষ করে টেলিভিশনসমূহ একযোগে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলে ধীরে হলেও ফল পাওয়া যাবে। আবার যে কোন একটি টেলিভিশনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে একাই এক শ' হতে পারে। বেসরকারী খাতে যদি এমন হতো যে, একটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল জনগণকে বুঝিয়ে দেয় 'বন্ধুগণ, যারাই আমার আপনার মায়ের ভাষার সঙ্গে অনর্থক ইংরেজী মেশায়, তারা শোষক এবং বিদেশীদের দালাল। বিদেশ থেকে আসা আপনাদের আত্মীয়স্বজনের ঘামের টাকা দিয়ে ওরা বিদেশী যন্ত্রপাতি কিনে এনে টেলিভিশনের পর টেলিভিশন বসিয়ে যাচ্ছে। এটার উদ্দেশ্য আপনাদের ভাষাটা নষ্ট করে দেয়া। ওই শহুরে মানুষগুলো ভাল না। বঙ্গবন্ধু বলেছেন 'ঐ ছাপকাপুড়্যা মানুষগুলা থাইক্যা বাঁইচা থাকবা'। পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর কথাই স্মরণ করবে।
পাঠক! বাংলার সঙ্গে ইংরেজীর ফোঁড়ন মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর প্রতিকারে প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। সমাধানটি সহজ এবং মাত্র কয়েক নিমিষের। কথা বলার ঠিক মুহূর্তে চকিতে ভেবে নিন ইংরেজী ফোঁড়ন দেবেন না। ব্যস! কথ্য বাংলা 'পিডগিন' হয়ে গেলে একদিন ওটা সাহিত্যের ভাষাও হয়ে যেতে পারে। ঐ সর্বনাশটি হলে বাঙালী জাতীয়তাবাদেরও ঘটবে নীরব অবলুপ্তি। বিষয়টি জরম্নরী চিনত্মার দাবিদার। বিষয়টির সঙ্গে ইংরেজী শিার কোন দ্বন্দ্ব নেই। ইংরেজী বিশ্বজনের ভাষা; মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান মাধ্যম ও আকর। ইংরেজী আমাদের শিখতেই হবে; তবে বলতে হবে যথাস্থানে এবং যথাযথভাবে। বাংলার সঙ্গে ইংরেজী এবং ইংরেজীর সঙ্গে বাংলা বলা অশিা ও কুশিার লণ।

No comments

Powered by Blogger.