বইমেলায় নারীর বই

আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস, ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রম্নয়ারি। প্রতি বছরের মতো এ বছরও শুরম্ন হয়েছে বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশে বইমেলা-২০০৭।
লেখক-পাঠক-প্রকাশকের অপূর্ব মিলন মেলা একুশে বইমেলা। প্রতিবছর এই মেলায় অসংখ্য নতুন বই প্রকাশিত হয়। নতুন বইয়ের ভেজা মলাটের ঘ্রাণ থেকে পাঠকরা খুঁজে ফেরেন প্রিয় লেখকের বই। বইমেলায় আমাদেও নারী লেখকদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। প্রতিবছরের মতো এবারও বেশ ক'জন নারী লেখকের বই প্রকাশিত হয়েছে। অপরাজিতার বর্তমান সংখ্যায় তেমনি কিছু বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরা হলো। গ্রন্থনা করেছেন সাব্রিনা আমিন
শূন্যতা
আকাশের দিকে তাকালে মন উদার হয়।/তোমার দিকে তাকালে মন অস্থির হয়।/নিজেকে দেখলে মনে জ্বালা ধরে।/নিজেকে দেখলে মনে হয় এতটা নিখুঁত/হবার কোনই প্রয়োজন ছিল না।/অযথা এই সৌন্দর্য। এ যেন প্রাণের টানে স্বতোৎসারিত কবিতা। কবি জাহিদা উর্মি মানব মনের জটিলতা কথপোকথনের ভঙ্গিতে তুলে এনেছেন তার কাব্যগ্রন্থে। শূন্যতা নামের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই পাঠকের দৃষ্টি কাড়তে সৰম এই কবি নিজেকে জানান দিতে সৰম হয়েছেন। মাত্র পঁয়তালিস্নশটি কবিতায় যখন একজন কবি তাঁর দিকে সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সৰম হন, তখন সেই কবির প্রতিভা সম্পর্কে বলার অপেৰা রাখে না। তাই কবি বেলাল চৌধুরী তার সম্পর্কে বলেন, কবিদের রাজা জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, কবিতা অনেক রকমের হয়। হতে যে পারে আমরাও জানি। কবিতামাতৃক বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষাতেও পয়ারের টান। আমার এই নবাগত কবিটির ৰেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তার কবিতাগুলো স্বতোৎসারিত প্রাণের টানে। কথোপকথনের ঢঙে রচিত কবিতাগুলিতে ৰোভ, বিষ্ময়, ক্রোধ পাশাপাশি উঠে এসেছে বয়নোচিত তারম্নণ্যের ঝলসানো দীপ্তিতে। কবি জাহিদা উর্মি'র শূন্যতা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য।

শ্রেষ্ঠ গল্প
কথাশিল্পের অঙ্গনে ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ পাঠকনন্দিত একটি নাম। দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বের ভেতর দিয়ে সাহিত্যভুবনে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অনুপম কথাসাহিত্যিক ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ-এর এ বইয়ে রয়েছে পঁচিশটি পাঁচমিশেলী গল্প। লেখকের ছোটগল্পের অজস্র সম্ভার থেকে বাছাই করা হয়েছে বিভিন্ন স্বাদের গল্প। উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-ভূমিহীন সমাজের সব সত্মরের মানুষদেও নিয়ে লেখা পাঠকপ্রিয় গল্পগুলোই গ্রথিত করা হয়েছে এ সংকলনে। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, হতাশা-গস্নানি গল্পগুলোর শরীরে বয়ে গেছে সাবলীলতায়। শুধু তাই নয়_ ভাষা ও সংলাপের স্বচ্ছমুকুরে ধরা পড়েছে মানুষের বিচিত্র চরিত্র। দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন, ধাঙড়ের মনোবেদনা, মেয়ে জনমের বেদনাদীর্ণ হাহাকার, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, জীবনের কেদ ও গস্নানির নিখাদ প্রতিফলন ঘটেছে তার গল্পে_ যা শিল্পের নন্দনতত্ত্ব পেরিয়ে মানবিকতায় উচ্চকিত হয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার দরম্নন তাঁর গল্পের পটভূমিতে ধরা দিয়েছে চেনামহলে। চারপাশের চেনা মানুষদেও কথা পড়তে পড়তে মনে হয়_ এ আমার গল্প, আপনার গল্প_ সবার গল্প। বাসত্মবের সানি্নধ্যে থেকে অনন্যভাবে জীবনকে দেখা ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ'র গল্পগ্রন্থ শ্রেষ্ঠগল্প প্রকাশ করেছে ইত্যাদি।

তবুও তুমি সীমানত্ম
মানব চরিত্র নানা বিষয়বৈচিত্র্য আর জটিলতার মিশেল। চোখে মেললেই এসব চরিত্রের সাথে আমাদেও কারো না কারো যোগাযোগ প্রেম পরিচয় ভালোবাসা ভালোলাগা ঘটে। মানুষের জীবনের সব পরিণতি কি সুখকর না বেদনায় ভরপুর অথচ সুখের সুদৃশ্য মোড়কে আচ্ছাদিত জীবনচক্র। এ অপার বেদনাভার নির্ণয়ে কিংবা কষ্টের তুলিতে মুখের ছবি অাঁকতে ক'জন সিদ্ধ। সে অনত্মজ্বালা বুঝবার অনত্মদৃষ্টিই বা কজনের আছে? রোকেয়া ইসলামের তবু তুমিই সীমানত্ম গল্পগ্রন্থে পোড়খাওয়া বঞ্চিত, ত্যাগী, প্রথাভাঙা মানুষের চরিত্রচিত্রন করেছেন আত্মার রস সিঞ্চন করে। মানুষের মর্মবেদনাকে মৌমাছির মতো করে আহরণ করেছেন পাঁজরের তলে। প্রতিটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন অত্যনত্ম সচেতন ভাবে ও মমতায়। মোট নয়টি গল্প স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। গল্পগুলোতে একে একে উঠে এসেছে কর্মভূমিতে বসে পেঁয়াজের খোসার মতো ফেলে যাওয়া জন্মভূমির প্রতি অদম্য পবিত্র টানের কথা, ধর্ম, দেশের বেড়াজাল ভেঙে সব মানুষের রূই একই। রোকেয়া ইসলামের গল্পগ্রন্থ তবু তুমিই সীমানত্ম প্রকাশ করেছে পারিজাত প্রকাশনী।

অপ্সরার ওড়না
সপ্তপদী উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ভালোবাসার পাঁচ পা। এখানে রয়েছে ভালোবাসার পাঁচ গল্প। প্রত্যেকটি কাহিনী নারীর ভালোবাসা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে। কিন্তু নারী কি সত্যিই ভালোবাসা পায়? তাকে যে কেবল হেওে যেতে হয়। সেই জেতে যার মন সবল। অপ্সরার ওড়না কখনো দেখতে পাওয়া যায় না। কিনত্ম তাকে পাওয়ার অপেৰায় সারাজীবন অপেৰা কওে বোকা মেয়েটি। ঘুমিয়ে যাবার আগে, ঘুমের মধ্যে, ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরও। দুঃখ জাগানিয়া নক্সি, নীল, অপ্সরার ওড়না, নিশি পাওয়া একজন এবং ভালোবাসার উতল হাওয়া নামের পাঁচটি গল্পে পাঁচ নারীর জীবনের গল্প বলেছেন মনিজা রহমান। সনত্মান খুন করলেও সে সনত্মানই থাকে। বাবা-মা, ভাইবোন কেউ কোনদিন পর হয় না। পর হয় সে শুধু স্ত্রী। পৃথিবীতে সেই হল সবচেয়ে ঘৃণ্যতম প্রতিপৰ। সমসত্ম দুনিয়ার রাগ ৰোভ-ঘৃণা উগড়ে দেবার স্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শাসত্মি গল্পে দেখিয়েছিলেন বউ গেলে বউ পাওয়া যায়, কিন্তু ভাই গেলে ভাই পাওয়া যায় না। সেই চিরনত্মন বাঙালি জীবনের গল্প উঠে এসেছে মনিজা রহমানের কলমে। মনিজা রহমানের অপ্সরার ওড়না গল্পগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জাগৃতি।

ভ্যানিটি ব্যাগে বুদ্ধিজীবীর মগজ
প্রতিটি মানুষের ভেতর ভালো আর মন্দ এই দুই সত্ত্বা সক্রিয় থাকে। প্রকৃতি থেকেই এ দুটি সত্ত্বা বিকশিত হয়। একটি মানবিক আর অন্যটি পাশবিক। প্রতিনিয়ত একটির সঙ্গে অন্যটির দ্বন্দ্ব চলে। কার ভেতর কোনটা বেশি সক্রিয় সেটি আপেৰিক। কোন মানুষের পাশবিক সত্ত্বা যখন তার ভেতরের মানবিক সত্ত্বাকে পরাজিত কওে তখন ঐ মানুষটির মসত্মিত্বের গুরম্নত্বপূর্ণ অংশটি অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী ধাপে সে নিজস্ব ৰুদ্র স্বার্থে বিক্রি হয়ে যায় অন্যের কাছে। যা তার চারপাশের মানুষের জন্য অপূরনীয় ৰতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় মানুষটি হয়ে ওঠে পাশবিক এবং আমরা তাকে নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করি। কবি মীরা মেহেরম্নন মানুষের জীবনের এই দুটি দিকের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটিয়েছেন তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ভ্যানেটি ব্যাগে বুদ্ধিজীবীর মগজ। প্রতীকী উচ্চারণে কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় উঠে এসেছে অসঙ্গতি এবং মানুষের অসহায়ত্বের কথা। মীরা মেহেরেম্ননের কাব্যগ্রন্থ ভ্যানেটি ব্যাগে বুদ্ধিজীবীর মগজ প্রকাশ করেছে জলসিঁড়ি প্রকাশনী।

No comments

Powered by Blogger.