কারা জীবনের উপাখ্যান

‘কারাগারে কারাবাসে’ সাহিত্যিক মাজহারউল মান্নানের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ। প্রথম গ্রন্থটি পাঠক সমাদৃত হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া উপন্যাস ‘চোখ ভেসে যায় জলে।’
ধ্রব এষ-এর আঁকা দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদের ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে অনন্যা প্রকাশনী। স্বাধীন স্বদেশ ভূমির এক ক্রান্তিলগ্নে লেখকের রাজনৈতিক জীবনের কারাবাস পর্বের জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়ের কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে এই গ্রন্থটি। মূলত জাসদের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে রক্ষী বাহিনীর হাতে ধৃত হয়ে ২৬ মাসের কারাগারের বন্দী জীবনের আত্মকথন এটি। কিন্তু গ্রন্থে সন্নিবেশিত তথ্য, জেল জীবনের কাহিনী এবং লেখকের শক্তিশালী গতিময় লেখনীতে গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত পাঠকমনস্ক উপন্যাসে।
এতে লেখকের প্রতি মানুষের ভালবাসা মমত্ববোধের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে। তেমনি অতিচেনা আপনজনের প্রতারণা, অবজ্ঞা, অবহেলার কথাও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে তাঁর কারা জীবনের সহযোগী এবং সঙ্গী সাথীদের জেল জীবন সংশ্লিষ্ট অজানা দুঃখ কষ্টের হৃদয়গ্রাহী বেশ কিছু গল্প। জেল জীবনের সাথীদের যে সমস্ত দুঃখ গাথা খণ্ড খণ্ডভাবে এসেছে তাও যথেষ্ট মর্মস্পর্শী এবং সুলিখিত। এ উপন্যাসের এসব টুকরো টুকরো গল্পও এক একটি সার্থক ছোট গল্প হিসেবে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
মাজহারউল মান্নানের লেখার ধরন অত্যন্ত সাদামাটা এবং সহজ সরল। হাল আমলের উপন্যাসের মতো অহেতুক বর্ণনার ঘনঘটা, কঠিন শব্দ প্রয়োগ বা তত্ত্ব উপদেশের কচকচানি নেই। রয়েছে সাবলীল ঝরঝরে এবং অতি সহজ ভাষার বর্ণনা। যা সর্বশ্রেণীর পাঠককে আকৃষ্ট করে এবং সম্মোহিত করে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় গল্প বা উপন্যাসের প্রান্ত সীমায়। পাঠককে আকৃষ্ট করার এই বিরল গুণ শিক্ষাবিদ মাজহারউল মান্নানের শুধু লেখায় নয়, তাঁর বক্তৃতায়, ক্লাসের লেকচারে এমনকি টেবিলটকেও পরিলক্ষিত হয়। তাঁর এই বিশেষ দক্ষতা বা গুণকে গুণগ্রাহীরা বলে থাকে Ñ ‘মাজহারউল মান্নান স্টাইল’। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তি Ñ ‘সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ মাজহারউল মান্নান তাঁর লেখনীতে রবীন্দ্রনাথের ওই উক্তিকে তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর দুটি উপন্যাসেই। বরং সহজ কথা সরল করে বলার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর লেখনীতে যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন আলোচ্য এই উপন্যাসে।
‘কারাগারে কারাবাসে’ উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয়েছে হঠাৎ করে এভাবে Ñ ‘অবশেষে রক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লাম। ধরা পড়লাম বলা ঠিক হবে না। বলা যায় ফাঁদে পড়ে ধরা খেলাম’। লেখা শুরুর এই ধরনটা সাধারণত ছোট গল্পের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু মাজহারউল মান্নান ১৬০ পৃষ্ঠায় একটি উপন্যাসের নান্দনিক সূচনায় তা প্রয়োগ করেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। শুধু তাই নয়, বর্ণনার বাহুল্য পরিহার করে গোটা উপন্যাসকেই তিনি অত্যন্ত সার্থকভাবে এমনি ছোট গল্পের আদলে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের সমাপ্তিও টানা হয়েছে এভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বর্ণনায়Ñ ‘গাড়ি সিলেট এলাকা পাড় না হতেই আমার মন পৌঁছে গেল বহুদূরের নিভৃত পল্লীর এক গৃহকোণে। যেখানে অনেক কান্না আর অনেক অভিমান নিয়ে অপেক্ষায় আছে আমার স্বজনরা।’
একজন শক্তিশালী লেখকই শুধু এভাবে একটি উপন্যাসের সূচনা ও সমাপনী টানতে পারেন। এ থেকে সহজেই অনমেয়। লেখকের লেখার গতিময়তা, শব্দ চয়ন আর গাঁথুনির বলিষ্ঠতা কতটা গভীর। উপন্যাসে মূল বিষয়ের বর্ণনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ওর মাঝে অন্য ঘটনাকে টেনে আনা এবং সে ঘটনার যথাযথ উপস্থাপন শেষে আবারও মূল বক্তব্যে ফিরে আসার ক্ষেত্রে লেখকের দক্ষতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। মূল গল্পের বর্ণনার ধারাবাহিকতায় কোন বিচ্যুতি বা ছন্দপতন না ঘটিয়ে টুকরো টুকরো নানা ঘটনার সমাহার ঘটিয়ে কাহিনীকে টেনে নেয়ার এই মুনশিয়ানা মাজহারউল মান্নানের লেখার একটা বড় গুণ।
এ দেশের গ্রামবাংলার চিরায়ত লোকজ গল্প বলার যে ধরন তা সব বয়সের শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে। মাজহারউল মান্নানের উপন্যাসের গল্প বলার ঢংয়ে এর প্রভাব বড় বেশি লক্ষ্য করা যায়। আর বোধকরি সে কারণেই তাঁর লেখা গল্প উপন্যাস সর্বশ্রেণী ও বয়সের পাঠককে মোহবিষ্ট করে। লেখার এই বিশেষ পারদর্শিতায় ‘কারাগারে কারাবাসে’ উপন্যাসটিকেও যে পাঠক লুফে নেবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
লেখক যদিও একে বলেছেন, তাঁর কারাবন্দী জীবনের স্মৃতিময় একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। কিন্তু এতে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বিধৃত হয়েছে দেশের সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কারাগারের নানা অনিয়ম অসঙ্গতি, অমানবিকতা।
প্রসঙ্গত, বীর মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলীকে আর্মড ব্যাটালিয়ন কর্তৃক পিটিয়ে হত্যা করার বিষয়টিসহ একজন নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর অমানবিক আচরণের ঘটনা এখানে একইভাবে উল্লেখিত হয়েছে। অত্যাচারিত মৃত্যু পথযাত্রী মুক্তিযোদ্ধা রোস্তমের শেষ উচ্চারণের কথাটি বলা হয়েছে এভাবেÑ “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেই স্বাধীনতা আজ শুধুই মৃত্যু যন্ত্রণা! আল্লার ওয়াস্তে আমাকে একটু পানি দাও’। কিন্তু একজন সিপাই তাকে পানি খেতে না দিয়ে প্যান্টের জিপার খুলে রোস্তমের মুখে পেশাব করে দিয়ে বলেছিল, Ñ ‘খা, কত পানি খাবি খা’। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা রোস্তমের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে যায় চিরতরে। ঠিক তখনই আনসার ক্যাম্পের গাছগুলো থেকে একঝাঁক পাখি কলোরব করে উড়ে যায়। বড় মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনী।” এ কথার মাধ্যমেই লেখক পাঠকদের কাছে না বলে অনেক কথা এবং তথ্য উন্মোচিত করেছেন। গ্রন্থে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চিত্রই লুকানো রয়েছে অতীব সাদামাটা বর্ণনার কাহিনীগুলোতে।
লেখক মাজহারউল মান্নান তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, Ñ ‘রক্ত মূল্যে কেনা স্বাধীন স্বদেশের ক্রান্তিকালে কারাবাস সময়ে কারাগারে সংঘটিত স্মরণযোগ্য কিছু ঘটনাকে বিস্মরণের কবল থেকে যথা সম্ভব রক্ষার উদ্দেশ্যেই এই প্রচেষ্টা। কিন্তু বইটি পড়ে একজন পাঠকের উপলব্ধি হবে এটা শুধু নিছক উপন্যাস নয়, এতে রয়েছে অনেক ইতিহাসের উপাত্ত। যা তিনি বিভিন্ন ঘটনা বিন্যাসের মধ্য দিয়ে পাঠক হৃদয়ে সম্প্রচারিত করে সুপ্ত চেতনাকে জাগ্রতও করতে চেয়েছেন। বোধকরি এখানেই একজন গল্পকারের প্রকৃত সার্থকতা যা এ গ্রন্থে যথার্থভাবে অর্জিত হয়েছে।
লেখায় দুঃখবোধ আবেগ বা সাসপেন্স সৃষ্টিতে মাজহারউল মান্নানের কলম যথেষ্ট সচল। যা সহজেই হৃদয়কে আবেগতাড়িত করে। আলোচ্য এই গ্রন্থে কারাগারের অবলা পশু মঙ্গল নামের মহিষকে রুটি খাওয়ানো, ডাকলে সাড়া দেয়া, বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে তার অকাল মৃত্যুর কাহিনী যে আন্তরিকতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। তা সামান্য এই ঘটনাটিকেও অসাধারণ করে তুলেছে। গ্রন্থে সে অংশের কষ্ট কল্পতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এমন ভাষা বিন্যাসেÑ ‘দিন যায় রাত নেমে আসে। যখন কোন কথা বলার লোক থাকে না, ভুল করেই ডাক দিয়ে বলি, মঙ্গল...। কোন সাড়া মেলে না। আমার সে আহ্বান জেলের প্রাচীরে বাধা পেয়ে প্রতিধ্বনী করে। কিন্তু সেই আকাক্সিক্ষত আঁ... উত্তর আর আসে না’।
মাজহারউল মান্নানের প্রথম আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘চোখ ভেসে যায় জলে’ যেমন তার নিবেদিত লেখনীর বলিষ্ঠতায় অগণিত পাঠকদের চোখও জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। ‘কারাগারের কারাবাসে’র গল্প কথার চিত্র কল্পগুলোও তেমনি পাঠকের মর্মমূলে ছুঁয়ে যাবে সেই প্রত্যাশা করি।
ঢাকা বাংলা বাজারের অনন্যা প্রকাশনীর ‘কারাগারে কারাবাসে’ এই উপন্যাসটির ছাপা, বাঁধাই অত্যন্ত সুন্দর। ১৬০ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য নির্ধারিত হয়েছে দুই শত পঞ্চাশ টাকা। নিঃসন্দেহে এটি সাম্প্রতিক সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। যা সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করবে। বইটি পাঠকনন্দিত হোক সেই প্রত্যাশা করি।
আবু জাফর সাবু

No comments

Powered by Blogger.