আড়ালে চলে যাচ্ছে ডেসটিনির দুর্নীতি by ফখরুল ইসলাম

বড় বড় ঘটনার কারণে আড়ালে চলে যাচ্ছে ডেসটিনির দুর্নীতি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা এখন নীরব। সবাই যেন গা ছেড়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈঠক করেও অন্যদের খুব বেশি সক্রিয় করতে পারছে না।
ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড ও ডেসটিনি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী কাজ করেছে, তা জানতে ২০ ডিসেম্বর সচিবালয়ে বৈঠক ডেকেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নিষ্ফলা ওই বৈঠকে সবাই নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
এ অবস্থায় ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ডেসটিনির অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ সংস্থাগুলোকে লিখিতভাবে জানাতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংস্থাগুলো হলো: বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), সমবায় অধিদপ্তর এবং যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য সংস্থার কথা বলা মুশকিল। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তার দায়িত্ব ঠিকই পালন করছে।’
ডেসটিনির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। গত ৩১ জুলাই করা মামলায় ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল আমীন, পরিচালক দিদারুল আলম এবং ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন এখন কারাগারে। গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদ শর্ত সাপেক্ষে জামিনে আছেন। দুদক মামলা করেছে—এই অজুহাতে বাকিরা ডেসটিনি নিয়ে এখন চুপচাপ। দুদক সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদেরও জামিন দেওয়ার জন্য একটি পক্ষ চেষ্টা করছে।
ডেসটিনির বিরুদ্ধে অর্থের অবৈধ ব্যবহারসংক্রান্ত দুটি মামলায় আসামির সংখ্যা ২২। তাঁদের মধ্যে ১৮ জন এখনো পলাতক। তাঁদের ধরার কোনো উদ্যোগ নেই।
মো. রফিকুল আমীন কারাগারে থাকায় ডেসটিনির সবকিছু এখন পরিচালনা করছেন তাঁরই ভাইয়ের ছেলে আশরাফুল আমীন। যোগাযোগ করা হলে গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন বিপদে। তবে সবারই জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছি।’ এর বাইরে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার করা তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটির বেশি টাকা সংগ্রহ করেছে ডেসটিনি। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকারই কোনো হিসাব নেই। এই অর্থের বড় অংশই পাচার হয়েছে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে আট মাস কাজ করার পর গত ১ অক্টোবর ৩৮৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)। অভিযোগ ছিল, বিভিন্ন দেশে হুন্ডি ব্যবসা করা, অর্থ পাচার, অবৈধ ব্যাংকিং, জঙ্গিদের অর্থায়ন, ভুয়া বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালু, অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি কাজ করছে ডেসটিনি। কিন্তু সরকারের দিক থেকে যথেষ্ট সহযোগিতার অভাব এবং ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় অনেক কিছুই প্রমাণ করা যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আটটি গুরুতর অনিয়ম উল্লেখ ও ছয়টি সুপারিশ করা হয়। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় করতে গত ২৩ অক্টোবর বাণিজ্যসচিবকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় একটি কমিটি। সমন্বয়ক হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অক্টোবরেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে যে যার আইন অনুযায়ী ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়। কিন্তু দুই মাস হতে চললেও কেউই কোনো কাজ করেনি বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব দুর্নীতি ও অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়, সেগুলো হলো: ডেসটিনি পরিবারভুক্ত ২২ ব্যক্তির নিজেদের মধ্যে শেয়ার লেনদেন, লোকসানি কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তহবিল তছরুপ, বেআইনিভাবে প্রতিষ্ঠানের অর্থ পরিচালকদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, চড়া সুদে অবৈধ ব্যাংকিং, বৃক্ষরোপণের নামে অর্থ সংগ্রহ ও অর্থের হদিস না থাকা, উদ্দেশ্য অনুযায়ী কোম্পানি পরিচালিত না হওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে কোম্পানির তথ্য গোপন এবং একচেটিয়া পণ্যের বাজার সৃষ্টি করে চড়া মুনাফায় পণ্য বিপণন।
সবাই নিষ্ক্রিয়: আইনকানুন লঙ্ঘনের দায়ে আদালতের মাধ্যমে ডেসটিনি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নিতে রেজসকোকে বলেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ডেসটিনির প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষা করেছে যেসব নিরীক্ষক, তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল।
সম্প্রতি বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) পদ্ধতির ৩১ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করেছে রেজসকো। এর মধ্যে ডেসটিনির একটিও বাতিল করা হয়নি।
অবৈধ ব্যাংকিং ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করায় বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৪, ৫১, ৫২, ৫৩, ৬৬ এবং ৬৭ ধারা অনুযায়ী ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলা হয়েছিল। আবার গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ পরিচালকেরা কীভাবে স্থানান্তরিত বা পাচার করেছে, তার বিশদ তদন্ত করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও বলা হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে।
এ ছাড়া প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ায় পরিচালকদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
এনবিআরকে বলা হয়, ডেসটিনি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায় করতে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা আছে, কর ফাঁকির খোঁজ নিতে ডেসটিনির ২৭টি কোম্পানির নথি পরীক্ষা করতে চাইলেও এনবিআর কোনো জবাব দেয়নি।
সমবায় আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ আর্থিক লেনদেন করেছে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধিত হওয়ায় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। এ ছাড়া ডেসটিনি গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন লঙ্ঘন করায় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে। সবশেষে এসইসিকে বলা হয়, তালিকাভুক্ত না হয়েও ডেসটিনি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রি করেছে, যা সিকিউরিটিজ আইনের পরিপন্থী। কিন্তু কোনো সংস্থাই ব্যবস্থা নেয়নি বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
কার, কী বক্তব্য: ২০ ডিসম্বেরের বৈঠক সূত্র জানায়, এনবিআরের প্রতিনিধি বলেছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে ডেসটিনি শতাধিক কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। তবে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তাই আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব জানিয়েছেন, তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি জানান, ডেসটিনি গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিবন্ধন না নেওয়ায় অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি গ্রাহকদের কাছ থেকে এক হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করে পরিচালকেরা নিজেদের নামে স্থানান্তর করেছেন, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও সমবায় আইনে অপরাধ। ব্যবস্থা নিতে সমবায় অধিদপ্তর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে বৈঠকে জানানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.