হল-মার্ক কেলেঙ্কারি- ব্যাংকের আট কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছেন তানভীর by অনিকা ফারজানা

হল-মার্ক গ্রুপ থেকে ঘুষ নিয়েই সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের জালিয়াতির সব ধরনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা অন্তত আটজন কর্মকর্তা নানা উপায়ে অর্থ নিয়েছেন হল-মার্ক থেকে। একাধিক কর্মকর্তা নগদ অর্থের বাইরে চিকিৎসা করানোর কথা বলেও টাকা নিয়েছেন।
এমনকি মোবাইল ফোনের মতো সামান্য জিনিসও তাঁরা হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন।
ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা কী পরিমাণ অর্থ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন এবং কীভাবে নিয়েছেন, তার বিবরণ রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে। তানভীর মাহমুদ একটি মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। সেই জবানবন্দিতেও ঘুষ দেওয়ার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
তানভীর মাহমুদ একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে জবানবন্দি দেন ১৮ অক্টোবর। রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে হল-মার্ক গ্রুপ ব্যাংকের সহায়তায় জালিয়াতি করে দুই হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। শাখা ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান এ কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। দুদক হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১১টি মামলা করেছে। তানভীর মাহমুদ ১৬৪ ধারায় এই জবানবন্দি দেন ৮ নম্বর মামলায়। মামলাটি করা হয়েছিল ৪ অক্টোবর।
রূপসী বাংলা শাখা থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। হল-মার্ক ছাড়াও আরও চারটি প্রতিষ্ঠান একইভাবে আত্মসাৎ করেছে এক হাজার কোটি টাকা। ওই চার প্রতিষ্ঠান হলো: টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট, নকশি নিট এবং ডি এন স্পোর্টস। এর মধ্যে টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন এবং নকশি নিটের মালিকেরা আগে হল-মার্ক গ্রুপেই কাজ করতেন। তিনজনই মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ছিলেন। হল-মার্ক গ্রুপের অর্থ জালিয়াতির সঙ্গে শুরুতে এই তিনজনের সংশ্লিষ্টতা ছিল। পরে তাঁরা নিজেরাই আলাদা আলাদা কোম্পানি খুলে ব্যাংকের সহায়তায় অর্থ আত্মসাৎ করা শুরু করেন। এই তিনজন হলেন: টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, নকশি নিট কম্পোজিটের মালিক আবদুল মালেক এবং প্যারাগনের সাইফুল ইসলাম রাজা।
ঘুষের তথ্য: আদালতে দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, তানভীর মাহমুদ ঘুষ দিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপক (সাময়িক বরখাস্ত) এ কে এম আজিজুর রহমান, সাবেক সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান (সাময়িক বরখাস্ত), নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন (সাময়িক বরখাস্ত), অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান, প্রধান কার্যালয়ের জিএম অফিসের মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথ (ওএসডি) ও মীর মহিদুর রহমান (ওএসডি), ডিএমডি আতিকুর রহমান, প্রধান কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থায়ন (আইটিএফডি) বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাফিজউদ্দিন আহমেদ (সাময়িক বরখাস্ত) এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলকে।
জবানবন্দিতে তানভীর মাহমুদ বলেছেন, ‘অর্থ জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংক ম্যানেজার আজিজ, এজিএম সাইফুল হাসান, কর্মকর্তা মতিন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান, ক্যাশ কর্মকর্তা সাইদুরের যোগসাজশ ছিল। আমার জিএম তুষার (তুষার আহমেদ), রাজা ও মালেক—এই তিনজন এসব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সময় টাকা দিত। শাখার কর্মকর্তাদের এভাবে আনুমানিক তিন কোটি টাকা দেওয়া হয়। সোনালী ব্যাংক জিএম কার্যালয়ে জিএম মীর মহিদুর ও অফিসার ওয়াহিদুজ্জামানকে (এই লোক বিভিন্ন সময় শাখা পরিদর্শনে আসত) প্রায় সময়ই দুই-পাঁচ লাখ টাকা করে মোট ৮০-৯০ লাখ টাকার একটা হিসাব দেয় আমাকে। জিএম কার্যালয়ের নতুন জিএম ননী গোপাল নাথকেও নাকি আমার লোকেরা বিভিন্ন সময় টাকা দিত।’
তানভীর এ বিষয়ে আরও বলেছেন, ‘ননী গোপাল নাথ কাজে যোগ দেওয়ার ১৫ দিন পরে অফিসে ডেকে নিয়ে তাঁর চিকিৎসার জন্য পাঁচ লাখ টাকা সাহায্য এবং তাঁর মেয়ের জন্য একটি ই-৭১ মোবাইল চায়। আমি ১৫ দিনের মধ্যে ওই টাকা ও মোবাইল দেই। প্রধান কার্যালয়ের আইটিএফডি বিভাগের সাবেক এজিএম সফিজউদ্দিনকে তসলিম, মালেক, রাজা ও আজিজ সপ্তাহে এক লাখ টাকা করে মোট ৭০-৮০ লাখ টাকা দিয়েছে বলে তারা আমাকে হিসাব দেখায়। এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের ডিএমডি আতিকুর রহমানকে আমি ম্যানেজার আজিজের কথামতো চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা দিই।’
তানভীর জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের তসলিম হাসান প্রায় সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও সাংবাদিকদের ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে অর্থ নিতেন। তানভীর আরও জানান, তাঁকে গার্মেন্টস ব্যবসায় নামান সাইফুল ইসলাম ও আবদুল মালেক। ওই দুজন তসলিম হাসানের সঙ্গে মিলে তানভীরের প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ঋণপত্র (এলসি) থেকে ৩০-৪০ শতাংশ কমিশন নিয়ে হল-মার্কের দেনা বাড়িয়েছেন। তানভীর মাহমুদ জানান, শেরাটন শাখার ম্যানেজার আজিজুর সব জেনেই বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে সবাইকে পৃথক ঋণ দিয়েছেন। এ রকম ভুয়া প্রতিষ্ঠান হলো: আনোয়ার স্পিনিং, ম্যাক্স স্পিনিং, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনাল, অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজ এবং স্টার স্পিনিং মিলস। হল-মার্কের সব দায় ওই সব ভুয়া কোম্পানির বিপরীতে সমন্বয় করেছেন ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান।
জবানবন্দি অনুযায়ী, তসলিম, মালেক, রাজা ও আজিজ সাহেব বিভিন্ন সময় হল-মার্কের জিএম তুষার আহমেদের কাছ থেকে বা ক্যাশ থেকে লাখ লাখ টাকা বিভিন্নজনকে দিয়েছেন। এমনকি অনেকের কাছে তানভীরের সই করা খোলা (ব্ল্যাংক) চেকও পাঠানো হয়েছে বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন তানভীর মাহমুদ।
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২৩ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মীর মহিদুর রহমান, শেখ আলতাফ হোসেন ও মো. সাফিজউদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করে দুদক। এর আগে ৮ অক্টোবর তানভীর মাহমুদ ও তুষার আহমেদ, ১০ অক্টোবর তানভীরের স্ত্রী ও কোম্পানির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামকে এবং ১৪ অক্টোবর শাখা ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিমধ্যে তাঁদের দুই দফা রিমান্ড শেষে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা।

No comments

Powered by Blogger.