ঈর্ষণীয় সফলতাই মুজিব হত্যার কারণ by সরদার সিরাজুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশের পর) আত্মসমর্পণ করলে অর্থ দাঁড়াত যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে পাকবাহিনীর সঙ্গে আপোস। তা যে হয়নি ইতিহাস তার প্রমাণ। বস্তুত ২৫ মার্চের সিদ্ধান্ত ছিল একটি কৌশল। এ ব্যাপারে কট্টর মুজিব সমালোচক ফরহাদ মাজহার ১৯৯৬ সনে ভোরের কাগজে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ‘মুজিব যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন এবং দুর্বল


অবস্থানে দাঁড়িয়ে বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে আর এক বৃহৎ শক্তির সাহায্যে লড়াইয়ের কৌশলের একটি নজির’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জনাব মাজহার লিখেছেন ‘পাক কারাগার তার শ্বশুরবাড়ি ছিল না। ফাঁসির দড়িটি গলায় ঢুকিয়ে মুজিব জনতার শক্তির দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীনতা, প্রয়োজনে তার রক্তের বিনিময়ে, তবে সেজন্য বাঙালীকে যেন চরম মূল্য না দিতে হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে চাপিয়ে দেয়ার জন্য চুক্তি করার জন্য ভারত যেন তাকে খুঁজে না পায়”। বঙ্গবন্ধুর এ সিদ্ধান্তটি ছিল এ রকম যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ভারতকে বলতে পেরেছিলেন “যে দেশ স্বাধীন হোক, নেতা মুক্তি পাক, তিনিই যা করার করবেন।” উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে, কৌশলটি ফলপ্রসূ হয়েছিল। যার ফলে তাজউদ্দীন আহমেদের পক্ষে ভারতের সঙ্গে কোন চুক্তি ছাড়াই সহযোগিতা আদায় সম্ভব হয়েছিল। তবে মুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরে রাষ্ট্র নায়কোচিত সীমাবদ্ধতার কারণে বঙ্গবন্ধু যে কথা বলতে পারেননি তা হচ্ছে, ভারত যাওয়া ছিল তার না পছন্দ। আর যারা তাকে চেনেন তারা জানেন যে, পালিয়ে যাওয়া স্বভাবের লোক তিনি ছিলেন না। সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটি হচ্ছে ২৫শে’র রাতে পালিয়ে গেলে শত্রুরা গুপ্তচররা তাকে মেরে ফেলে স্বাধীনতার স্বপ্ন নস্যাৎ করে দিত।
৫. ভাষাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠা হয়নি।
৬. মূলনায়ক শত্রুর কারাগারে, অথচ তার নামেই যুদ্ধÑজয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
৭. বিজয় অর্জনের মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠানো। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪৫) সময় থেকে ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনী পশ্চিম জার্মানিতে এখনও অবস্থান করছে। সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহৃত হয়েছে পূর্ব জার্মানি থেকে ১৯৮৯ সনে। ৮. বিদেশী সৈন্য দেশে অবস্থানকালেও ৫৭টি দেশের স্বীকৃতি আদায়। ২ বছরে ১২১টি দেশ স্বীকৃতি দেয়। আর বঙ্গবন্ধুর পরে মাত্র দুটি দেশ সৌদি আরব ও চীন স্বীকৃতি দেয় যদিও তা ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আমলেই। ৯. মাত্র ১০ মাস সময়ে সংবিধান প্রণয়ন।
১০. ১৯৭২ সনে প্রণীত মূল সংবিধান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধান। এর পরে গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরি হয়নি। মার্কিন, ব্রিটিশ এবং আরও অনেক আধুনিক রাষ্ট্রের মুদ্রায় ‘ইন গড উইস্ট্রাস্ট’ আছে এবং গ্রীস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশের পতাকায় ক্রস প্রতীক। ভারতের মূল সংবিধানের মূল নীতিমালায় ‘সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রকে’ সংবিধান (দ্বিচত্বারিশ সংশোধন) আইন ১৯৭৬ সনে সংশোধন করে ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র’ হিসেবে ৩ জানুয়ারি ’৭৭ থেকে প্রতিস্থাপিত হয়। অথচ ধর্ম নিরপেক্ষতা ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে বলে বলা হয়। যার দাঁতভাঙ্গা জবাব আমরা দিতে পারি না।
১১. ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় হানাদার, পাকিস্তানী বাহিনীর ৯৩ হাজার নিয়মিত সৈনিক রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রকাশ্যে বিশাল জনতার সামনে আত্মসর্মপণের ঘটনা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
১২. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- ও ইতিহাসে নৃশংসতম। কেননা, যিশু, ইসলামের তিন খলিফা, লিংকন, কেনেডি, গান্ধী প্রমুখ হত্যাকা- কেবল স্ব স্ব আততায়ীর হাতে নিহত হন। ঘাতকরা ঢাকা শহরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি তার স্ত্রী, ৩ পুত্রের সকলকে দুই পত্রবধূসহ সে বাড়ির সবাইকে এবং দুই নিকটাত্মীয় পরিবারে হত্যাকা- চালায়।
১৩. স্বল্প সময়ে বিশ্বে ঈর্ষণীয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত (১০ জানুয়ারি ’৭২) ভারত ও ভুটান ছাড়া অন্য কোন দেশ স্বীকৃতি জানায়নি। বিদেশী সৈন্য ভূখ-ে অবস্থানকালে স্বীকৃতি আদায় কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মার্চ ’৭২ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করলেও সে সময়কালেই প্রথম তিন মাসের মধ্যে স্বীকৃতি মিলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ৬৩ দেশের। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজয় অর্জনের ৩ মাস ২১ দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ২ বছর ২ মাসের মধ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ তারিখে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া দেশের ১২৩টির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আমলে ’৭২ সালে ৯৬টি, ’৭৩ সালে ২০টি এবং ’৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫টি সর্বমোট ১২১টি দেশ। (চলবে)

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.