উপজেলা পরিষদের নতুন কাঠামো by এ এম এম শওকত আলী

পত্রিকান্তরে জানা গেছে যে, ১০টি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ যাচ্ছে উপজেলা চেয়ারম্যানদের হাতে। অর্থাৎ ১০টি বিভাগ ব্যতীত বাকি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় সরকার। দশটি বিভাগের মধ্যে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতরও অন্তর্ভুক্ত।


একই সাথে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কিছু পৃথক দায়িত্ব ও কার্যাবলীও প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব, ভূমি প্রশাসন, আইনশৃংখলা, রাষ্ট্রাচার পালনসহ তার অধীনস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্ব বণ্টন। অর্থাৎ এ সব বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানদের কোন কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এর ফলে দ্বৈত প্রশাসন বিরাজ করার আশঙ্কাই অধিকতর।
তবে মূল বিষয়টি হচ্ছে উপজেলা চেয়ারম্যানের মতা প্রসঙ্গে। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় উপজেলা পরিষদের শক্তিশালীকরণের বিষয়টি গৌণ হওয়ারই আশঙ্কা বেশি। এখানে পরিষদকে নয়, নির্বাচিত ব্যক্তিকে প্রাধ্যান্য দেয়া হয়েছে বেশি। এর ফলে উপজেলা পরিষদের সকল মতার কেন্দ্রবিন্দু হবেন চেয়ারম্যান। এখানেও সমস্যা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার সাংসদদের নির্বাহী মতা প্রদান করার বিষয়টি উপজেলা আইনসহ সরকারী আদেশে বা নীতিমালায় স্বীকৃত। এ েেত্রও বিরাজ করবে দ্বৈত শাসন। বলা যায় ত্রিমুখী শাসন। কারণ কিছু কর্তৃত্ব উপজেলা চেয়ারম্যানের, অধিকতর কর্তৃত্ব স্থানীয় সাংসদদের এবং কিছু নিয়ন্ত্রণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। সাংসদরা উপজেলা পরিষদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন করা যায় তাহলে কর্তৃত্ব কেন?
ফিরে দেখলে বলা যায় যে, ১৯৮৪ সালে যখন উপজেলা পরিষদ কাজ শুরু করে তখন দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ও তাদের জোটভুক্ত অন্যান্য দল উপজেলা প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জ্ঞাপন করেছিল। তাদের যুক্তির মধ্যে ছিল (এক) একজন সামরিক শাসক এ ধরনের প্রথা প্রর্বতন করার মতা রাখে না এবং (দুই) এর ফলে সামরিক শাসক নিজেকেই স্থায়ীভাবে মতাসীন রাখতে সম হবে। বলা বাহুল্য যে, এ প্রথা সংবিধানসম্মত ছিল। সামরিক শাসকদের নিজস্ব রাজনৈতিক দলভুক্ত নির্বাচিত সাংসদরাও ঐ সময় উপজেলার ওপর কর্তৃত্ব লাভের দাবি করেছিল। তারাও পরিষদের উপদেষ্টা হতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু তৎকালীন সরকার তাদের এ দাবি মেনে নেয়নি। একই সময়ে উপজেলার নিয়ন্ত্রণভুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের ওপর কর্তৃত্বের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপজেলায় কর্মরত কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন লেখার মতা প্রদান করা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন বিভাগ আপত্তি উত্থাপন করে। তাদের যুক্তি ছিল এর ফলে জেলায় কর্মরত-কর্মকর্তারা এদের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বহীন হওয়ার ফলে প্রশাসনে বিশৃক্মখলা সৃষ্টি হবে। এ ধরনের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটি সরকারী আদেশও জারি করা হয়। এতে বলা হয় যে, কারিগরি নিয়ন্ত্রণ জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অুণ্ন থাকবে এবং চেয়ারম্যানের লেখা বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন প্রতিস্বার করার মতা তাদের অুণ্ন রইবে। স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত পর্যবেক ও গবেষকদের মতে উপজেলা পর্যায়ে প্রথম বারের নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তাদের মধ্যে। বর্তমান প্রথায় এ ধরনের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব অবসানের একটি উপায় গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে পত্রিকায় তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। যে উপায়টি চিহ্নিত করা হয়েছে তার ফলে নির্বাহী কর্মকর্তাকে কোন বেআইনি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার মতা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু পুনর্বিবেচনান্তে সিদ্ধান্ত না বদল করলে তা কার্যকর করা হবে কিনা সে বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই।
স্থানীয় সরকারবিদরা হয়ত বলবেন যে, এ ধরনের প্রথা বা মতা একজন কর্মকর্তাকে প্রদান করার ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধি বা পরিষদের মতা ুণ্ন করা হবে। ভারতের অন্তত দুটি রাজ্যে এর চাইতেও এ প্রথাকে অধিকতর শক্তিশালী করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ ধরনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রাদেশিক সরকারকে অবহিত করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কামনা করতে মতাবান। উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতর্ৃক স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ কমিটিও একই প্রথা অনুসরণের সুপারিশ করে এবং তা অধ্যাদেশেও সংযোজন করা হয়।
উপজেলা পরিষদ তথা শক্তিশালী স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধানসম্মত একটি নতুন প্রথা। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশাসনিক কাঠামো ও মতার বিভাজন সম্পর্কে অনেক ধরনের অসুবিধা ও অস্পষ্টতা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেকের মতে ১৯৮৪ সাল পরবর্তী পর্যায়ে এ কাঠামোর স্থায়ীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ও কার্যকর করার সম্ভাবনা ছিল। তবে এ প্রথাকে ১৯৯১ সালে বাতিল করার ফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নতুনভাবে এ প্রথাকে চালু করার ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে একই সমস্যা থাকবেই। উদ্দেশ্য হবে সমস্যার প্রতিকারমূলক আইনসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিছু ব্যক্তি সংগঠন সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও স্বশাসিত করার প েসংবিধানের মূল স্তম্ভ হলো রাষ্ট্রীয় তিনটি প্রধান অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য রা করা। স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতার সাথে ভারসাম্যের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যদি স্বাধীন ও স্বশাসিত হয় তাহলে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ কি শক্তিশালী রইবে?
বাংলাদেশের েেত্র এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করা সহজতর হতো যদি এ দেশে প্রাদেশিক সরকারের ব্যবস্থা বিরাজ করত। এ ব্যবস্থা না থাকার ফলে সব দায় কেন্দ্রীয় সরকারের। যার ফলে যে সমস্ত বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচ্য হওয়ার কথা না, সে বিষয়েও এ সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হচ্ছে। বিকল্প হিসাবে তা হলে কি প্রদেশ গঠন যুক্তিযুক্ত হবে? প্রদেশ গঠনের প েসাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ একাধিকবার প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করেছেন। তবে এ প্রস্তাব এখনও গৃহীত হয়নি। কারণ কি?
কারণটা সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা। সংবিধান মতে বাংলাদেশ একটি একক রাষ্ট্র। অনেকেই বলবেন যে, বৃহত্তর প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করলেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ ধরনের প্রস্তাব দেয়া যত সহজ, কার্যকরী করা তত সহজ নয়। স্মরণ করা যেতে পারে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে হাইকোর্টকে বিকেন্দ্রীভূত করে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে হাইকোর্ট চালু করার পর এর বিরুদ্ধে আইনজীবীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয়। কারণ ছিল ঐ সময়ের সরকার হাইকোর্টকে বিকেন্দ্রীকরণের ল্যে সংবিধান সংশোধন করে। সংশ্লিষ্ট রিট মামলায় যুক্তি প্রদান করা হয় যে, সংবিধান মতে বাংলাদেশ একটি একক রাষ্ট্র। এ জন্যই হাইকোর্টের আঞ্চলিক বেঞ্চ গঠন করা সংবিধানসম্মত নয়। সুপ্রীমকোর্ট এক চূড়ান্ত রায়ে এ যুক্তি গ্রহণ করে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি অসাংবিধানিক ও অকার্যকর ঘোষণা করে। ঘটনাটি সম্ভবত ১৯৮৮ সালের। ফলশ্রুতিতে আঞ্চলিক বেঞ্চ প্রথা বাতিল হয়। সে ব্যবস্থাই ঐ সময় থেকে চালু আছে।
এ প্রসঙ্গে বর্তমান আইনমন্ত্রীর একটি সাম্প্রতিক উক্তি লণীয়। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, সংবিধানের কয়েকটি মৌলিক ধারা সংসদও সংশোধন করার মতাবান নয়। এ বিষয়ে আরও উল্লেখ করা যায় ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট কয়েক বছর পূর্বে একটি চূড়ান্ত রায়ে একই ধরনের নির্দেশ প্রদান করেছে। বর্তমান সংবিধানের সংশোধনীর বিষয়টি এ আঙ্গিকেই বিবেচনা করার প্রয়োজন হবে। যে কোন অবিবেচনাপ্রসূত সংশোধনী করলে হিতে বিপরীত হওয়ারই আশঙ্কা অধিকতর, যা অতীতে হয়েছে।
স্থানীয় সরকারবিদসহ স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত কিছু সংগঠন সময় সময় মত প্রকাশ করেছে যে, বর্তমান ব্যবস্থায় দুইভাবে শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। এক. আমলানির্ভর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। দুই. সাংসদদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। প্রথমোক্ত বিষয়ে উল্লেখ করা যায় যে, এ ধরনের যুক্তি অনেকটা একপেশে। উপজেলা তথা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর আমলাদের কোন নিয়ন্ত্রণ করার মতা প্রদান করা হয়নি। যে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তা কেবল অনিয়ম ও দুনর্ীতির বিষয়ে তদন্ত করা বিষয়েই সীমাবদ্ধ। এ দায়িত্ব যে কোন দেশের কাঠামোতে বিদ্যমান। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করবে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর অনিয়ম ও দুনর্ীতির তদন্ত দুনর্ীতি দমন কমিশনের ুদ্র আমলারাই করে থাকেন। আর্থিক অনিয়মের তদন্ত সিএজির আমলারাই করেন। এতে আপত্তি করার কোন যুক্তি নেই। আইনের মতাবলেই তাঁরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
বিকল্প হিসাবে ইতোপূর্বে জারিকৃত অধ্যাদেশে একটি স্বাধীন ও নিরপে স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করার বিধান ছিল। এ কমিশন গঠনও করা হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে সংসদই সিদ্ধান্ত প্রদান করে, আমলারা নয়। এ কমিশন স্থায়ীরূপ লাভ করলেও কমিশন মূলত এসব বিষয়ে আমলাদের মাধ্যমেই তদন্ত কার্য সম্পাদন করত। কারণ সব ধরনের তদন্ত করা তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের প েসম্ভব ছিল না। মূল প্রতিবন্ধকতা সাংসদদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় দলীয় নিয়ন্ত্রণ, যা কাম্য নয়। পৃথিবীর কোন দেশেই এ ধরনের ব্যবস্থা নেই। দণি এশিয়ার দেশেও নেই।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.