তথাকথিত নিরাপদ চলাচলে বেপরোয়া পথচারী বেপরোয়া চলাচল ১ by রাজন ভট্টাচার্য

মগবাজার মোড়ে বিকেল যখন তিনটা তখন শত-শত পরিহনের ব্যস্ততা। কার আগে কোনটি যাবে। চলছে প্রতিযোগিতা। একটু সুযোগ পেলেই বেপরোয়া গাড়ির টান। এছাড়া সিগন্যালে বিভিন্ন প্রান্তে আটকে আছে কয়েক শ’ গাড়ি। এর মধ্যেই ইস্পাহানি স্কুলের শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক এমনকি পথচারীরা হাত দিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার


হচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন দৌড়। কেউ গাড়ি থামাতে চোখ রাঙাচ্ছেন চালকের দিকে। নগরীর এই পয়েন্টে এ রকম দৃশ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই চোখ পড়ে। চালকের একটু অমনযোগিতার কারণে যে কোন সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। নিভে যেতে পারে জীবন প্রদীপ। অথচ রাস্তা পারাপারে রয়েছে ওভারব্রিজ। ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতকরা দুই থেকে তিনভাগ মাত্র। রাজধানীজুড়েই চলছে আইন ভেঙ্গে রাস্তা পারাপারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
প্রকৃত অর্থে নগরীর রাস্তায় বেপরোয়া পথচারী। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে রাস্তা পারাপার এখন সবখানেই। সিগন্যালের লাল-সবুজ যে আলোই জ্বলে থাক সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই কারও। নেই আইনের প্রতি তোয়াক্কা। জীবনের ঝুঁকিও পরোয়া করেন না ঢাকার মানুষ। অনেক সময় রোড ডিভাইডার টপকে রাস্তা পারাপার হতে দেখা যায় নগরবাসীকে। অথচ রাস্তা পারাপারে রয়েছে ৩৮টি ফুট ওভারব্রিজ। তিনটি আন্ডারপাস। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দুই ভাগ মানুষও রাস্তা পারাপারে এর কোন কিছুই ব্যবহার করেন না। এদিকে রাস্তা পারাপারে আইন অমান্য করায় ট্রাফিক আইনে ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন শাস্তির বিধান নেই। এ জন্য স্টপ ফাইন চালুর পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যে দেখা গেছে, গড়ে প্রতিদিন নগরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে একজন মানুষ। বছরে ৩৬৫ জন। এর মধ্যে আইন ভঙ্গ করে রাস্তা পার হওয়ার সময় বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকে পঙ্গু হচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আইন মানার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা।
জনস্বার্থে ॥ সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে পুলিশ বক্সের সামনে মাইকের আওয়াজ। দূর থেকে শোনা যাচ্ছেÑ ‘নিরাপদে রাস্তা পারাপার হোন। রাস্তা পারাপারে কেউ ঝুঁকি নেবেন না। রাস্তা পারাপারে ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস ব্যবহার করুন। অন্যথায় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি’। সামনে গিয়ে দেখা গেল ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রচার চলছে। ট্রাফিক বিভাগের এক সদস্য দিনে অন্তত ৫-৭ ঘণ্টা এ কাজই করেন। জনস্বার্থে যেখানে এ রকম মাইকিং চলছে এর ঠিক পাশেই দেখা গেল উল্টো চিত্র। বলতে গেলে আইন না মানার মহোৎসব। যে যার মতো করে রাস্তা পার হচ্ছেন। অথচ কেউ ওভারব্রিজ ব্যবহার করছেন না। কানে মোবাইল গুজে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছেন অনেকে। দুই হাতে দুই শিশু সন্তান, কাঁধে ব্যাগ তবুও জীবনের প্রতি কোন দরদ নেই! গাড়ি থামাতে আকিব হাসান মিনিবাস চালকের দিকে চোখ রাঙাচ্ছিলেন। অথচ পুলিশের করণীয় কিছু নেই।
নগরীর ব্যস্ততম পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত ফার্মগেট, শাহবাগ, বাংলামোটর, মৌচাক, পল্টন, কমলাপুর, বাড্ডা, নতুন বাজার, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, বনানী, টিকাটুলি, প্রেসক্লাব, কারওয়ান বাজার, গুলিস্তানসহ আরও এলাকা। এসব পয়েন্টে ওভারব্রিজ কিংবা ওভারপাস থাকলেও ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। ট্রাফিক সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিং কোন কিছুতেই আইন মানার বালাই নেই।
পরিবহনের গতি রোধ করে রাস্তা পারাপার নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। অনেক সময় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেন পথচারীরা। কিন্তু এত আইন অমান্য করার নেপথ্য কারণ কি? এ নিয়ে জনকণ্ঠে’র সঙ্গে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের। কেউ বলেন, হাত উঁচিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পারাপার যে অপরাধ এ বিষয় সম্পর্কে কারও স্পষ্ট ধারণা নেই। অর্থাৎ সচেতনতার অভাব। কারও বক্তব্য রাস্তা পারাপারে বিকল্প নেই, তাই আইন অমান্য করতে হচ্ছে।’
মালিবাগ রেলগেট এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের হাত যতবার ওপরে ওঠে এর চেয়ে কয়েকগুণ ওঠে পথচারীদের হাত! কারণ এই স্থানে কোন ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস নেই। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কারণে পথচারীদের চলাচল বেশি। তাই দিনে শত-শতবার আইন ভাঙ্গার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। মৌচাক এলাকার চিত্র আরেকটু ভিন্ন। এখানে একাধিক মার্কেট হলেও পার্কিং নেই। যানজটে অস্থির। ওভারব্রিজের অর্ধেক হকারদের দখলে। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পরাপারের দৃশ্য এই স্পট থেকে শুরু করে মালিবাগ, শান্তিনগর, কাকরাইল, নয়াপল্টনসহ আশপাশের সব এলাকাতেই। গাউছিয়া এলাকায় রাস্তা পারাপার ঠেকাতে রোড ডিভাইডারে উঁচু করে গ্রিল দেয়া হলেও কাজ হচ্ছে না। গ্রিল টপকে রাস্তা পার হচ্ছেন অনেকে। এই পয়েন্টের ওভারব্রিজটি হকারদের দখলে।
ঢাকার ক্রসিং ও ট্রাফিক তথ্য ॥ ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের তথ্য মতে, ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অধীনে দুই হাজার ২৭৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। ৬৫০টি ক্রসিং আছে এই সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৩০০টি। এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ৭০টি সিগন্যাল বাতি আছে। এছাড়াও ঢাকার ওপরে রেলপথে রয়েছে ৩৬টি লেভেল ক্রসিং। রাস্তায় গাড়ি রয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি। ১৭০টি রাস্তায় ৬ হাজার ১০০টি বাস চলাচল করছে। বাস কোম্পানি রয়েছে ১৩৭টি। ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত জনবলের সংখ্যা তিন হাজার ৫৫৮। ৩৮টি ফুট ওভারব্রিজ। তিনটি আন্ডারপাস রয়েছে। নির্মাণাধীন ওভারব্রিজের সংখ্যা ১০টি। আইন অমান্য করার অপরাধে প্রতিমাসে ৬০ হাজারের বেশি মামলা হচ্ছে।
ভারতে ১০-২০০ টাকা জরিমানা ॥ প্রতিবেশী দেশ ভারতে পথচারী সিগন্যাল ভেঙ্গে অথবা মোবাইল কানে রাস্তা পেরোলে ১০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান করা হয়েছে। লোকবল সঙ্কটের কারণে সেখানেও এই আইন শতভাগ কার্যকর না হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেকটা সচেতন সে দেশের পুলিশ। কিন্তু আমাদের দেশে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ ও সিগন্যাল অমান্য করার অপরাধে পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকলেও পথচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কোন বিধান নেই।
বাস্তবায়ন হয়নি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ॥ চলতি বছরের শুরু থেকেই নগরীতে অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার হলেই ২০০ টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ২০১১ সালে ১৮ ডিসেম্বর এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগে সিটি কর্পোরেশনকে সকল ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস পরিষ্কারসহ মেরামতের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বৈঠকে বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে রাস্তা পারাপারের কারণে দিন দিন যানজট যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এই প্রেক্ষাপটে আন্ডারপাস ও ওভারপাস ব্যবহার করা অনেকটা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তা পারাপারে সচেতনতামূলক কর্মসূচী পালন করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। জরিমানারও হদিস নেই।
স্পট ফাইনের পরামর্শ ॥ এই মুহূর্তে ট্রাফিক আইন সংশোধন করা না গেলেও ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস এলাকায় স্পট ফাইন করে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যেতে পারে। তবে সক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আন্ডারপাস ও ফুট ওভারব্রিজ পারাপার বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ পুলিশের। এছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে তাকেও আনতে হবে জরিমানার আওতায়।
ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত সহকারী পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) মোঃ মঈনুল হাসান জনকণ্ঠ’কে বলেন, সরকার জনস্বার্থে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ফুট ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস নির্মাণ করেছে। পথচারীরা চলাচলের নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ তা ব্যবহার না করলে এটাই হবে আইন ভঙ্গের শামিল। আইন ভঙ্গ করার অপরাধে যে কোন ব্যক্তিকে থানায় দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই অপরাধে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইনে কোন শাস্তির বিধান নেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান ট্রাফিক আইনে যুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.