কোথায় হারাল ইলিশ by চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম

বর্ষার মাঝামাঝি, পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোন সময়েই মাঝ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে-নৌকার আলো ওগুলো।


সমস্তরাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সঙ্কেতের মত সঞ্চালিত হয়। এক সময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে, গ্রামে, রেল-স্টেশনে ও জাহাজঘাটে শ্রান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষ রাতে ভাঙা-ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি উঠে। জেলে-নৌকার আলোগুলি তখনো নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মত দেখায়।
দেবীগঞ্জের মাইল দেড়েক উজানে কুবের মাঝিদের এই মাছ ধরার বর্ণনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৬ সালে লিখেছিলেন তাঁর 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসে। আর ২০১২ সালে কী অবস্থা?
কুবের মাঝিদের জালে এই বর্ষায় এখন পর্যন্ত ১০ কেজি ইলিশও ওঠেনি পদ্মার বুক থেকে! বিপন্ন আবু জাফরের কথাগুলো চাপা কান্নার মতো শোনায়- 'এই পদ্মা এখন মর‌্যা গ্যালছে।.... মরা পদ্মায় ইলিশ আসবে কেথ্যাকা।' ফারাক্কা না হয় পদ্মাকে মেরে ফেলেছে। আষাঢ়-শ্রাবণের এই ভরা মৌসুমেও মেঘনাতেও তো ইলিশের আকাল। এই জলজ সোনার দেখা নেই কিত্তনখোলাতেও। বঙ্গোপসাগরেও জাল পেতে বসে থাকতে থাকতে জেলেরা ক্লান্ত। নেই ওরা।
কেন এই অবস্থা
ইলিশের এই আকালের পেছনে রয়েছে মূলত দুটো কারণ। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট সংকট। প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে অন্যতম হলো আবহাওয়া বদল। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে নদীর পানির উষ্ণতা বাড়ছে। বজ্রবৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়াও একটি সমস্যা। এ ছাড়া সাগর মোহনায় পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়া। আর মানবসৃষ্ট কারণের অন্যতম হলো বাদ-বিচারহীন শিকার। বিশেষ করে বাচ্চা ইলিশ (জাটকা) নির্বিচারে ধরা। এর সঙ্গে রয়েছে নদীদূষণ। নদীতে ক্ষতিকর বর্জ্যের পরিমাণ সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বেঁচে থাকার নূ্যনতম পরিবেশ না থাকলে মাছও থাকবে না- সেটাই রীতি। এসব সংকট ইলিশের ওপর কী রকম প্রভাব ফেলছে তার পরিষ্কার একটি চিত্র মিলবে যদি আমরা এই মাছটির বিচরণ, স্বভাব ও প্রজনন পদ্ধতির দিকে চোখ ফেরাই।
মাছের রাজা
পদ্মা-মেঘনার ইলিশ বলে বিক্রেতারা যতই গলাবাজি করেন না কেন এই মাছ কিন্তু সামুদ্রিক প্রাণী। দল বেঁধে জীবনের বেশির ভাগ সময়টা এরা কাটিয়ে দেয় সাগরে। প্রজননের সময়টাতে, অর্থাৎ ডিম পাড়ার জন্য এরা উঠে আসে নদীতে। বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে ইলিশের বিচরণস্থল হচ্ছে মূলত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা অববাহিকা। আর পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা। বছরে দুইবার ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটাতে এরা নদীতে ঢোকে। একবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে, আরেকবার ফেব্রুয়ারি-মার্চে। স্বভাবগত কারণে ইলিশ ৪০ ফুট গভীরতায় চলাচলে অভ্যস্ত। গভীরতা এর কম হলেই মাছের চলাচল বিঘ্নিত হয়। আমাদের সমুদ্র মোহনায় কোথাও কোথাও গভীরতা ১৫ ফুটের মতো। ফলে নদীতে না ঢুকে ইলিশ ডিম পাড়ছে মোহনাতেই। এটা স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী। এতে ইলিশের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশের নদী বিশেষ করে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের পাঁচটি অভয়াশ্রম আছে। চাঁদপুর, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও বরিশালসংলগ্ন এসব অভয়াশ্রমে এসে ইলিশ ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। মৎস্য বিশেষজ্ঞ ড. আনিসুর রহমানের মতে, একটি ইলিশ যে ডিম পাড়ে তার থেকে এক লাখ রেণু পোনা উৎপন্ন হয়। আশ্বিনের পূর্ণিমায় ইলিশ ডিম ছাড়ে। সেজন্যই ৬ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় জাল দিয়ে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তখনো জাল ফেলে মা মাছ ধরা হয় নির্বিচারে। আর বাড়িতে বাড়িতে ইলিশের ডিমের স্পেশাল ডিশ তৈরি হয়। একটি ডিম মানে এক লাখ ইলিশ নাশ। এরপর পাঁচটি অভয়াশ্রমে শুরু হয় জাটকা প্রজনন মৌসুম। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জাটকা বেড়ে উঠতে থাকে দ্রুততার সঙ্গে। এর মধ্যে মার্চ ও এপ্রিল হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় সব নদীতে জাল ফেলা নিষিদ্ধ। কিন্তু জেলেরা এ নিষেধাজ্ঞা মানেন না। জাল তো জাল, অত্যন্ত ছোট ফাঁসের কারেন্ট জাল ফেলে তারা নির্বিচারে ধরেন জাটকা। ফলে ভরা মৌসুমে তাঁদের জাল ফাঁকা। দাদনের টাকা গেল বলে হাপিত্যেশ। না খেয়ে মরার দশা। অথচ তাঁরা একটুও ভাবেন না, প্রতিবছর তাঁরা যে ১৪ হাজার ১৫০ টন জাটকা ধরেন এর ২০ ভাগও যদি রক্ষা পেত তাহলে এক লাখ ৭০ হাজার টন অতিরিক্ত ইলিশ পাওয়া যেত। যার বাজার মূল্য তিন হাজার কোটি টাকা।
ইলিশ রক্ষার এসব আইন-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারের প্রচণ্ড উদাসীনতা আছে। নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতেও চরম অনীহা লক্ষণীয়। বজ্রবৃষ্টি কমে যাওয়া, নদীদূষণ, ডুবোচর আর কারেন্ট জালের বাড়বাড়ন্তের কারণে নদী থেকে ইলিশ হাওয়া। এখন যেটুকু মাছ ধরা পড়ছে তা সাগরে। সেখানেও বিপত্তি। গভীর সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা জানিয়েছেন, সেখানে ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা ট্রলিং বোটের সাহায্যে নির্বিচারে চিংড়ি শিকার করছেন। ফলে তাঁদের টপকিয়ে গভীর সমুদ্রে গিয়ে ইলিশ ধরতে পারছেন না বাংলাদেশের জেলেরা।
আরো দুঃসংবাদ আছে। বাংলাদেশে উপকূলের পরিবেশ দিন দিন বিরূপ হয়ে ওঠার কারণে ইলিশের ঝাঁক মিয়ানমারের ইরাবতী মোহনার দিকে চলে যাচ্ছে। আরেকটি দল গুজরাটের তাপ্তি মোহনার দিকে সরে গেছে। পরিস্থিতি যা তাতে করে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ পান্ডা, ডোডো পাখি বা এক শিংওয়ালা গণ্ডারের মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায় নাম উঠিয়ে ফেলবে।
পদ্মার ইলিশের সুনাম কেন?
সমুদ্রে ধরা পড়া ইলিশের স্বাদ অতটা রাজকীয় নয়। কিন্তু তারা যখন নদীতে ঢোকে তখন থেকে মাছের স্বাদ বদলাতে থাকে। একটি মাছ তার জীবনকালে ১২ শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। প্রজনন মৌসুমে বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে ইলিশ পাড়ি দেয় ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পথ। সমুদ্রের নোনা পানি থেকে মাছ যত উজানের পথে ছুটতে থাকে ততই তার শরীর থেকে ঝরতে থাকে আয়োডিন, লবণসহ আরো কিছু খনিজ পদার্থ। এ সময়টাতে ইলিশ কিছু খায়ও না। এভাবে চলতে চলতে উজানের শেষ সীমানা পদ্মায় (ফারাক্কা বাঁধের কারণে) পৌঁছানো ইলিশ স্বাদে-গন্ধে হয়ে ওঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
করণীয়
ইলিশ রক্ষা করতে হলে এ মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ শিকার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। জাটকা ধরার শাস্তি আরো বাড়াতে হবে। নদীর নাব্যতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। নদীদূষণ ঠেকাতে আরো কঠোর আইন করতে হবে।
অবশেষে রপ্তানি বন্ধ
ভরা মৌসুমেও বাংলাদেশে ইলিশের চরম আকাল চলছে। রোজায় এই মাছের কেজি দেড় হাজার টাকায় পৌঁছেছে। যেটুকু মাছ ধরা পড়ছিল তার প্রায় পুরোটাই রপ্তানি ও পাচার হয়ে যাচ্ছিল ভারতে। অবশেষে ৩১ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মাছ রপ্তানি বন্ধ করে। এর আগ পর্যন্ত পূর্ববর্তী পাঁচ-ছয় দিনে বেনাপোল দিয়ে বৈধ পথে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে বলে সে দেশের মাছ ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে। অথচ এ সময়টায় রাজধানীসহ বাংলাদেশের বাজার ছিল প্রায় ইলিশশূন্য। অবশেষে সরকারের এই বিলম্বিত বোধোদয়কে স্বাগত জানিয়েছেন ইলিশপ্রেমীরা।
ইলিশ তথ্য

No comments

Powered by Blogger.