পোশাক শিল্পে অস্থিরতা নিরসনে আলোচনা জরুরি by ইফতেখার আহমেদ টিপু

দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা চলতে থাকলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য অশুভ বার্তা বহন করে; এটি আমাদের কাম্য নয়। দেশের সামগ্রিক অর্থ খাতে পোশাক শিল্পের ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। কৃষি খাতের পর এ খাতটি দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে।


দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সর্ববৃহৎ খাতও এ শিল্প। তা ছাড়া এ খাতে নিয়োজিত রয়েছে দেশের সবচেয়ে বেশি জনশক্তি। সস্তায় শ্রমিক ও গুণগত মানের কারণে বিশ্ববাজারে আমাদের পোশাক শিল্পের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। যেকোনো কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে কোনো ধরনের অসন্তোষ সৃষ্টি হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর।
অভিযোগ রয়েছে, দেশি ও বিদেশি কিছু গোষ্ঠী আমাদের গার্মেন্ট শিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে এবং তারাই বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা সেই অভিযোগ অস্বীকার করছি না; কিন্তু এটাও কি সত্য নয় যে আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকরা গার্মেন্ট রপ্তানিকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে? আর যদি কোনো ষড়যন্ত্র থেকেও থাকে, তাহলে যৌক্তিকভাবেই তার মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষকেই যৌক্তিক অবস্থানে থাকতে হবে। দাবি জানানো এবং দাবি আদায়ের চেনা পথগুলো দিয়েই শ্রমিকদের হাঁটতে হবে। ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ, রাস্তা অবরোধ করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে তারা শুধু মালিকদের নয়, একসময় দেশবাসীরও ক্ষোভ-বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আবার মালিকদেরও কারখানায় স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে আরো বেশি যত্নবান হতে হবে।
আমাদের দেশে এ ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেও এক শ্রমিক অসন্তোষের সময় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় গাড়িচাপায় এক নারী শ্রমিক নিহত হন। এভাবে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি দেশের পোশাক শিল্পকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করছে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটাচ্ছে; কিন্তু কোনো দীর্ঘস্থায়ী সুরাহা হচ্ছে না। এ শিল্পে বারবার এমন অসন্তোষে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশের পোশাক শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কেননা একটানা দীর্ঘ সময় ধরে কারখানা বন্ধ থাকলে মালিকরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্ডার মোতাবেক ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না। ফলে এ খাত অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে। তাই কেন শ্রমিকরা হঠাৎ করে বেতন কাঠামো বাড়ানোর জন্য আন্দোলনে গেল এবং তাদের বর্তমান বেতন কাঠামো কী এবং তা চলমান শ্রম আইনের সঙ্গে কতটুকু সংগতিপূর্ণ তা বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন। এ ছাড়া কিছুদিন পরপর এসব অসন্তোষের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি না বা কোনো মহল তাদের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য ইন্ধন জোগাচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। আমরা মনে করি, শ্রমিকদের বঞ্চিত করে নয়; বরং তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই উদ্ভূত পরিস্থিতির দ্রুত মোকাবিলা করা প্রয়োজন।
সাফল্য অর্জনের চেয়ে সেটি ধরে রাখা কম দুরূহ নয়। গত দুই যুগে হাঁটিহাঁটি পা পা করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখন বিশ্বজুড়ে একটি স্বীকৃত নাম। স্বাধীনতার পর যে দেশের মানুষ বিদেশি পুরনো পোশাক পরে লজ্জা ঢাকত, শীত নিবারণ করত, সে দেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশের এই সাফল্য এসেছে সস্তা শ্রমের কারণে। গার্মেন্টে কর্মরত ২০ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিকের নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকার বদৌলতে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। চীনকে পেছনে ফেলে এ স্থান দখল করার যে স্বপ্ন তাঁরা দেখছেন, তা বাস্তবতার নিরিখে ধরাছোঁয়ার বাইরে কিছু নয়। তবে গার্মেন্ট মালিকদের অনুদার মনোভাবের কারণে তা দুরাশায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও সমভাবে বিদ্যমান। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশের ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সম্পর্কে সন্তুষ্টি থাকলেও যাঁরা এ পোশাক তৈরি করেন, সেই শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে অসন্তুষ্টি দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন ব্যবসায়ীদের আস্থার সংকটও সমভাবে বিবেচ্য বিষয়। গত মঙ্গলবার মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা এ বিষয়ের প্রতিই দৃষ্টিপাত করেছেন। বলেছেন, 'গার্মেন্ট সেক্টরে উন্নত কর্মপরিবেশ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশের পণ্য কিনে নিজেদের সুনাম নষ্টের ঝুঁকি নেবেন না মার্কিন ব্যবসায়ীরা।' গত এপ্রিলে গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের নিহত হওয়ার ঘটনা, কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সংগঠন করার সুযোগ নিয়ে মার্কিন ব্যবসায়ীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে- এমন কথাও বলেছেন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা। আমি মনে করি, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সময় থাকতেই কর্মপরিবেশ উন্নয়নে গার্মেন্ট শিল্পের উদ্যোক্তারা নজর দেবেন- এটি একান্তই কাঙ্ক্ষিত। একইভাবে এ শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের পথেও যেতে হবে। তার বদলে শ্রমিকদের উপেক্ষা করার মনোভাব পেয়ে বসলে সেটি হবে আত্মহত্যার শামিল।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.

No comments

Powered by Blogger.